বহুদিন ধরে বিটিভি দেখা হয়না। ইত্যাদি ছাড়া বিটিভি তেমন দেখা হয়না বললেই চলে। আজ ডিস না থাকার সুবাদে বিটিভিই দেখতে লাগলাম। সুন্দর একটি অনুষ্ঠান চলছিল। ইসলামে নারী ও শিশুদের মর্যাদা নিয়ে আলোচনা। তারা বলছেন ইসলামে নারীদেরকে ৪ ভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো:-
১. শিশু হিসেবে নারীর মর্যাদা
২. বোন হিসেবে নারীর মর্যাদা
৩. স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা এবং
৪. মা হিসেবে নারীর মর্যাদা
শিশু হিসেবে পিতামাতার উপর, বোন হিসেবে ভাইয়ের উপর, স্ত্রী হিসেবে স্বামীর উপর এবং মা হিসেবে সন্তানের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিশুর সুস্বাস্থ্যের অধিকার রয়েছে যা পিতামাতা নিশ্চিত করবে। বোন হিসেবে পরিবারের পক্ষ থেকে সুপাত্র দেখে বিয়ে দিবে। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে। ভালো সম্পর্ক রাখবে। এককথায় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হবে মধুর। তারা কেউ কাউকে গালি দিবেনা। পরস্পরের সাথে ঝগড়া করবেনা। মা হিসেবে সার্বিক দায়িত্ব সন্তানকেই পালন করতে হবে। ইসলামে বলা হয়েছে মাতাপিতা অসন্তুষ্ট হলে স্বয়ং আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।
আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে বাংলাদেশের নারীদের সার্বিক অবস্থান নিম্নরূপ :-
শিশু হিসেবে নারীর অবস্থান খুবই ভালো পর্যায়ে রয়েছে। সব মাতাপিতাই তাঁদের সন্তানকে সাধ্য মতো সেবা-যত্ন করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করে। দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া মোটামুটি শিশু অবস্থায় নারীরা খুবই ভালো অবস্থানে থাকে বলা চলে। অসচ্ছলতার কারণে কিছু পরিবারের শিশুরা কাজকর্মে নিয়োজিত হলেও মাতাপিতার ভালোবাসার কোনো ঘাটতি থাকেনা।
বোন হিসেবে নারীদের অবস্থান মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে । অনেক ভাই আছে যারা তাদের বোনকে প্রচন্ড ভালোবাসে। সুপাত্র দেখে বিয়ে দেয়। সার্বিক খোঁজ খবর রাখে। বিপদে আপদে সাহায্য করে। স্বামীর বাড়িতে কোনো অন্যায় করলে মীমাংসার ব্যবস্থা করে। আবার অনেকেই আছে এমনভাবে ভালোবাসে যে তার বোন কোনো জায়গায় অন্যায় করতে পারে তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনা। বিচার বিশ্লেষণ না করেই অন্ধ ভক্তের মতো বোনকে সাপোর্ট দিয়ে সংসারে আগুন লাগায়। তবে এটা ব্যতিক্রম। অনেকেই আছে বোনকে দুচোখেও দেখতে পারেনা। পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। বোন এবং বোনের স্বামীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে ভাই ভালো থাকলেও ভাবী তার সাথে খারাপ আচরণ করে। তখন স্ত্রীর কথায় বোনের সাথে ভাই সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
তবে স্ত্রী হিসেবে তাদের জায়গাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শক্তিশালী হয়। শিক্ষিত হয়ে থাকলে এই জায়গাটায় তারা একটু বেশিই সুবিধা ভোগ করে। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। অনেক স্বামী আছে ৩/৪ টা বিয়ে করে। অনেকে আছে যৌতুক নিয়ে ভেজাল করে। অনেক পরিবারে শ্বশুর শ্বাশুড়ি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা তারা নির্যাতিত হয়। তারপরেও আনুপাতিক হারে এখানেই তারা শক্ত অবস্থানে থাকে। চাকুরীজীবি হলেতো আর কথাই নাই। স্বাবলম্বী হওয়া অবশ্যই দরকার। কিন্তু এই স্বাবলম্বী হওয়ার কারণেই তারা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে তোয়াক্কা করেনা। সর্বশেষ জরিপে বাংলাদেশে স্বাবলম্বী মহিলাদের বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক ।
মা হিসেবে একজন নারীর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। অসম্ভব যন্ত্রণায় কেউ কেউ জর্জরিত। অনেকেই আছে মাতাপিতাকে সম্মান তো দূরের কথা মাতাপিতার খোঁজও নেয়না। অতচ সে যে একদিন বৃদ্ধ হয়ে এই অবস্থায় আসতে হবে তার কোনো চিন্তাও করেনা। আবার অনেকেই আছে মাতাপিতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ হলেও বউয়ের জন্য সেভাবে করতে পারেনা। ওই বউ যে একদিন কারো মা হয়ে বৃদ্ধাবস্থায় উপনিত হবে তার কোনো তোয়াক্কা করেনা । উপরন্তু সে একজন মা জাতির হয়েও আরেকজন মা কে অপমানিত করে প্রকারান্তরে কষ্টও দেয়। আবার অনেকেই আছে এমনভাবে বউয়ের ভক্ত যে বউকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা! বউয়ের কথায় উঠবস করে নিজের মাতাপিতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে। আবার কোনো কোনো এলাকার কালচারই হলো বউয়ের সুখের জন্য পিতামাতাকে সাথে রাখা যাবেনা। টাকাপয়সা যাই লাগে লাগুক তা দিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করে। মা হিসেবে নারীর এই জায়গাটা খুবই নড়বড়ে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে একটা আইন হয়েছে মাতাপিতার একাধিক সন্তান হলে মাতাপিতা যার কাছে থাকতে চায় তার কাছেই থাকতে দিতে হবে। তাহলে এই জায়গাটা তাদের জন্য নিরাপদ। কিন্তু না! তাও ওই সন্তানের বউয়ের মন-মানসিকতার উপর নির্ভর করে। বউ যদি একটু বেসামাল হয় তাহলে এখানেও ঝামেলা আছে! যদিও আদালত দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। এমনও অনেক পরিবার দেখি যাদের ৩/৪ জন সন্তান সবাই পিতামাতাকে সাথেই রাখতে চায় কিন্তু কোনো পুত্রবধূই বৃদ্ধ শ্বশুর শ্বাশুড়িকে রাখতে চায়না।
গ্রামের অনেক অশিক্ষিত পিতামাতা দেখি যারা কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করায়। ছেলে ভালো চাকরি করে। শিক্ষিত মেয়ে দেখে বিয়ে করায়। কিন্তু ওই শিক্ষিত বউমা তাদেরকে অশিক্ষিত, মূর্খ, ক্ষেত বলে গালি দেয়! সবকিছুতেই কেমন যেন একটা গরমিল পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ মা হিসেবে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবহেলিত। এর মধ্যেও অনেকেই আছে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিজের মায়ের মতোই আদর যত্ন করে। তবে এ সংখ্যাটা খুবই নগন্য।
সার্বিকভাবে নারীদের অবস্থান যাইহোক মা হিসেবে নারীরা যাতে অবজ্ঞার পাত্র না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। যাদের মা বাবা পৃথিবীতে বেঁচে আছেন তাদের ব্যাপারে যথাসম্ভব আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। মনে রাখতে হবে মা বাবার দায়িত্ব শুধুমাত্র সন্তানের উপরই বর্তায়। এক্ষেত্রে স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা। যদি স্ত্রী কিছু করে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। চাপ প্রয়োগ করা জঘন্যতম অন্যায়। আবার স্ত্রীর কথায় মা বাবাকে অন্যত্র ফেলে রাখা যাবেনা। ভালোভাবে টেককেয়ার করা সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ কর্তব্য পালন করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। শুধুমাত্র টাকাপয়সা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবেনা। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা বিবেচনা করে শুধুমাত্র ভালোটাই গ্রহণ করতে হবে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম সরকারের এককালীন এক শীর্ষ আমলা তাঁর মা মারা যাওয়ার পর স্ট্যাটাস দিয়েছে প্রায় এরকম ‘সরি মা দায়িত্বের কারণে তোমার সেভাবে দেখবাল করতে পারিনি’! বিষয়টি আমার কাছে খুবই উৎকন্ঠাজনক মনে হয়েছে। কেন আপনি কি তখন স্ত্রী সন্তানকে টেককেয়ার করেন নি? স্ত্রী সন্তান নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরতে পারেন তাহলে মায়ের ব্যাপারে সরি কেন? মনে রাখতে হবে আপনি শীর্ষ আমলা হোন আর যাই হোন আপনাকে কিন্তু মা বাবার টেককেয়ার করতেই হবে। এখানে সরি বলার কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও শেষপর্যন্ত তাঁর বোধোদয় হওয়ায় অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনেকেই আছে মা বাবা অসুস্থ হলে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয় এমনকি ICU তে থেকে ছবি তুলে দোয়া চায় আমার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচায়ক হিসেবে মনে হয়। আমার ছেলে ICU তে ছিল আমি জানি সেখানে থাকলে মন-মানসিকতা কেমন থাকে। একটু সেবাযত্ন করারই সময় পাওয়া যায়না। তাহলে ছবি তুলার সময় পায় কেমনে?
মোটকথা হলো মা বাবাকে ভালোবাসুন। তাদের সঠিকভাবে যত্ন নিন। খেয়াল রাখুন। শুধু বেহেশতের আশা করে নয় বরং অসহায় মানুষগুলোর প্রতি নিজের দায়িত্ববোধ থেকে করুন। তবে স্ত্রী সন্তানের অবজ্ঞা করে নয়। আমার বিশ্বাস যারা মা বাবাকে টেককেয়ার করার চেষ্টা করে তারা স্ত্রী সন্তানকে কখনও অবজ্ঞা করেনা বা করতে পারেনা। মা বাবার প্রতি যার দায়িত্ববোধ থাকে স্ত্রী সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ববোধ অটোমেটিক এসে যাবে।
আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুক।।।
মো. শরীফ উদ্দিন
প্রভাষক, বিশ্বনাথ সরকারি কলেজ
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.