২০ ভাগ অর্থ বরাদ্দের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন
শিক্ষা জাতীয়করণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে সব ধরণের বৈষম্য দূরীকরণে জাতীয় বাজেট ২০২১-২২ এ
২০ ভাগ অর্থ বরাদ্দের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ আবুল বাশার বাশার হাওলাদার।
সংগঠনের মহাসচিব মো. জসিম উদ্দিন সিকদার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন," আমরা সবাই জানি, বিশ্ববাসী আজ মহাসংকটময় ক্রান্তিকাল পার করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ কোটি মানুষ কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনো লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুর মিছিলে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিন। আমরা সবাই আজ আতঙ্কিত, প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে শঙ্কার মধ্যে। সবার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারপরও জীবন-জীবিকার তাগিদে জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত আছি সবাই। হয়তোবা এ সংকট একসময় কেটে যাবে। তবে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা হবে চ্যালেঞ্জিং।' তিনি আরও বলেন,
"আপনারা জানেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাত। প্রায় পনেরো মাস যাবত সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন। শিক্ষকরা নানাভাবে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতনের সরকারি অংশ পাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানের অংশ পাচ্ছেন না। তাছাড়া এমপিওবিহীন প্রায় তিন লাখ শিক্ষক -কর্মচারী আছেন। তারা আদৌ কোনো বেতন পান না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ননএমপিও প্রায় সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় আছেন। তাদের জীবন অচল হয়ে গেছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে অনেকে হতাশার আগুনে জ্বলছে। এমনকি অর্থকষ্টে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। প্রায় দুই লাখ শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তারা নানা পেশায় নিয়োজিত হওয়ার চেষ্টা করছেন যা শিক্ষকসুলভ নয়।" তিনি উল্লেখ করেন,
"আপনারা অবগত আছেন, দেশের ৯৭ ভাগেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখেরও বেশি শিক্ষক -কর্মচারী চাকরি করছেন। তারা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আর্থিক ও সামাজিকভাবে। ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১০০০ টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পাচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষক -কর্মচারীরা। তাছাড়া প্রধান শিক্ষক,সহকারি প্রধান শিক্ষক, প্রভাষক, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সহকারি অধ্যাপকদের বেতনবৈষম্য ও পদোন্নতির অনেক বিড়ম্বনা রয়েছে। এ সকল বৈষম্য দূর করে একটি বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এটা জাতির জন্য লজ্জাকর ব্যাপার বলে আমরা মনে করি।"
সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন,
"আপনারা জানেন, ১৯৯৪ সালে ইউনেসকো-আইএলও যৌথভাবে একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির নির্দেশনা দেয়। সেখানে বলা হয় শিক্ষকরাই হবেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি এবং তাদের নিরাপত্তা,আর্থিক সুবিধা সর্বোচ্চ হবে। সেই রেজুলেশনে বাংলাদেশসহ ১০০টিরও বেশি দেশ স্বাক্ষর করেছিলেন। আমাদের পাশের দেশ ভারত, শীলঙ্কা ও পাকিস্তানে শিক্ষাখাতে শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১১থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থ বরাদ্দ থাকে না। তাছাড়া বিভিন্ন প্রোজেক্টে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। সেসব ক্ষেত্রে অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি লক্ষ করা যায়। তাই একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন-বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।"
তিনি বলেন,"এই মহাদুর্যোগে শিক্ষার্থীরাও নানা সংকট দিন কাটাচ্ছেন। তাদের অভিভাবকরা অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন।অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এই অভাব-অনটনের মধ্যে মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন, ছেলেরা শিশুশ্রমে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের কীভাবে আবার শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া আপনারা জানেন,পনেরো মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন সংসদ টিভি ও অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত আছে। তবে নানা প্রতিকুলতার মধ্যে এসব পাঠদান প্রক্রিয়া তেমন সাফল্য পায়নি। বিশেষ করে অনলাইন পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কোনো আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সম্পৃক্ততা নেই। ইন্টারনেট অ্যাকসেস , ডিভাইসসহ নানা সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাশ তেমন সফল হচ্ছে না।"
"এবারের শিক্ষাবাজেট হতে হবে অন্য বছরগুলোর চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে। কারণ এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। এই মহাদুর্যোগে সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ দেশের সব নাগরিক দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। হয়তোবা শিগগিরই খুলে দেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা পূরণে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ এবং তা বাস্তবায়ন। নিম্নে তুলে ধরছি শিক্ষাবাজেটের পরিধি কেমন হবে।"
"১. সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা
২.শিক্ষাখাতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা।
৩.শতভাগ উৎসব ভাতা, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ভাতা প্রদান করা।।
৪.অনার্স-মাস্টার্স, ননএমপিও, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করা।
৫. অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা,যাতে তারা ৩০ দিনের মধ্যে টাকা হাতে পান এবং মাসিক পেনশন পান।
৬. অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ,প্রধান শিক্ষক, সহকারি প্রধান শিক্ষক, সহকারি অধ্যাপক, প্রভাষকসহ সকলের উচ্চতর গ্রেড নিশ্চিত করে বাজেটে বরাদ্দ রাখা।
৭. শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যাংকঋণ মওকুফ করা।
৮.ননএমপিও শিক্ষক -কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা মাসে মাসে দেওয়া হোক।
৯. তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের বেতনক্রম ১১ গ্রেডে উন্নীত করা।
১০. শিক্ষার্থীদের জন্য মিড ডে মিল চালু করা, যাতে তাদের শারীরিক পুষ্টি নিশ্চিত হয়।
১১. অস্বচ্ছল অভিভাবকদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া।
১২. অনলাইন শিক্ষার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট, ডিভাইস কেনার জন্র বিশেষ বরাদ্দ রাখা।
১৩. শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঋণ চালু করা।
১৪.শিক্ষকদের দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা।
১৫. বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু করা।
১৬. ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা।
উল্লেখিত ১৬ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য ২০ শতাংশ অর্থ বাজেট বরাদ্দ রাখার জোর আহ্বান জানাচ্ছি।"
সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ আবুল বাশার হাওলাদার বলেন , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৩ জুন খুলে দিতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী- অভিভাবক সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে। অনলাইন ক্লাশ সফল করার লক্ষ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ইলেক্ট্রোনিকস ডিভাইসের সুবিধা দিতে হবে। শিক্ষা আইন ও নতুন কারিকুলাম আগে মাঠ পর্যায়ে যাচাইয়ের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। আমলাতন্ত্রের হাত থেকে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে মুক্ত করে শিক্ষাবিদদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অফিসগুলো ঢেলে সাজিয়ে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে হবে। প্রয়োজনে যেকোনো প্রশাসনিক রদবদল করতে হবে। যেহেতু শিক্ষার সাথে দেশের সব মানুষ সম্পৃক্ত, তাই এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাখাতে ২০ ভাগ বরাদ্দ দিয়ে তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সরকারের ২০৩০ ও ২০৪১ রপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আর এ শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকের মান উন্নত করতে হবে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, অতিরিক্ত মহাসচিব শহীদুল্লাহ প্রিন্স, যুগ্ম মহাসচিব আবুল খায়ের, যুগ্ম মহাসচিব আবুবকর সিদ্দিকী, যুগ্ম মহাসচিব এ, কে আজাদ, সাংগঠনিক সচিব সরদার আবদুল কাইয়ুম, সাহিত্য সচিব আব্দুল মান্নান, প্রচার সচিব সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ।