এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমরা পেছনে কেন
অলোক আচার্য।।
মাঝে মধ্যেই বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সেরা তালিকা প্রকাশ করা হয়। এবং অধিকাংশ সময়ই আমরা দেখেছি যে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এতে প্রথম কয়েকশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও স্থান পায়নি।
প্রশ্ন ওঠে এবং এটাই স্বাভাবিক। এশিয়ার মধ্যে অন্যতম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন এই তালিকার উপরের দিকে থাকে না বা নেই সেই প্রশ্নও স্বাভাবিক। যাচাইয়ের মানদন্ডের কথায় পরে আসছি।
যদি ভারত বা পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যায় এসব র্যাঙ্কিংয়ে থাকতে পারে তবে আমরা কেন পারবো না সেই প্রশ্ন আসে। এবার যেমন যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত এ তালিকায় এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম আসেনি।
এই ব্যর্থতার কাদের? আমরা কেন এই দায় নেব না? ভারতের এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় যদি সেরা ৩০০ এর মধ্যে থাকে তাহলে আমাদের একটিও কেন থাকবে না? আমরা তো আশা করছি না যে আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম তিনশ এর মধ্যে থাকতে হবে।
অন্তত একটি বা দুটি হলেও আমরা বলতে পারি। এটা কি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের শিক্ষা নিয়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না? উন্নয়নের একটি সেরা ক্ষেত্র হলো শিক্ষা। এবং বিশ্ববিদ্যালয় হলো সর্বশেষ ক্ষেত্র। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী একজন পরিপূর্ণ মানুষ ও সম্পদ হয়ে দেশের হাল ধরার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে।
এবারও সেরা ৩০০ তালিকায় ভারতের ৪০টি, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এশিয়ার ৩১ দেশের মোট ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র্যাঙ্ককিং করা হয়েছে।
র্যাঙ্ককিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম চীনের জিংহুয়া ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয় চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি, তৃতীয়, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, চতুর্থ সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং পঞ্চম জাপানের ইউনিভার্সিটি অব টোকিও।
সেরা দশের মধ্যে আরও আছে ইউনিভার্সিটি অব হংকং, চিনের সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটি, ফুদান ইউনিভার্সিটি, শেজিয়াং ইউনিভার্সিটি এবং হংকংয়ের দ্য চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৩০১-৩৫০'র মধ্যে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অবস্থান ৩৫১-৪০০'র মধ্যে। এছাড়া, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৪০১-৫০০'র মধ্যে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫০১-৬০০'র মধ্যে।
ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তালিকার ৩২তম অবস্থানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স। পাকিস্তানের সেরা কায়েদ-ই-আজম ইউনিভার্সিটির অবস্থান ১২১তম। শিক্ষাদান, গবেষণা, জ্ঞান বিতরণ এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ মোট ১৮টি বিষয়ে মূল্যায়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিংকিং করেছে টাইমস হায়ার এডুকেশন।
এই তালিকা থেকে দেখা যায় যেসব দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় নেই তাদের অনেক দেশের সাথেই আমাদের দেশের কয়েকটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। যেমন পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। তারা অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের দেশের চেয়ে দুর্বল। অথচ আমরা জানি বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে।
অন্তত দেশে আজ অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে মানুষের ধারণা আজও বেশ স্বচ্ছ। প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিযোগীতা দেখে সেটা অনুমান করা যায়।
একটি আসনের বিপরীতে কত অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। তালিকায় আমাদের দেশের কোন বিশ^বিদ্যালয় থাকুক আর না থাকুক তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না কিন্তু অনেক প্রশ্ন থেকে যায়।
কেন এতগুলো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উপরের দিকে বা ভারত, পাকস্তিান বা মালয়েশিয়ার পাশাপাশি আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকা প্রায় দুর্লভ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাহলে কি কোন গলদ রয়ে গেছে। থাকলে সেটা কোথায়।
তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। বিষয়টি যদি আমরা ছেড়েও দেই তাহলেও প্রশ্ন বাদ যাবে না। কারণ আমাদের কোথায় সমস্যা সেটা তো খুঁজে বের করতেই হবে। তার আগে শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা যে, সবক্ষেত্রে যদি আমরা অন্য দেশকে ছাড়িয়ে যাই তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকাটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়।
বরং এই ক্ষেত্রে আমাদের কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এবং যে জায়গায় ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষা মানুষের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত শক্তি জাগ্রত করার কাজ করলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রয়োগের উদ্দেশ্য এবং ধরণেই এমনটা হচ্ছে বলাই যায়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের আজকের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া।
একটা সার্টিফিকেট আর চাকরি তারপর জীবনে আর কোন দুঃশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের দেশে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বহুবার ঘষামাজা করা হয়েছে। কখনো কোন বিষয় বাতিল করা হয়েছে আবার প্রয়োজনের খাতিরে কোন বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল ব্রিটিশরা।
মূলত ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কিছুটা পরিবর্তন করে আজও আমাদের দেশে চলছে। ইংরেজ সাহেবদের সেই ই”ছার প্রতিফলন আজও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখতে পাই।
আমাদের পোশাকে, আমাদের চালচলনে আমরা সর্বদাই সেই সাহেবদের অনুসরণ করার করি। নিজেদের সংস্কৃতিকে গুলিয়ে আমরা পর সংস্কৃতির শিক্ষাই লাভ করতে শিখেছি।
পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেশে রীতিমত যুদ্ধ হয়। আমাদের দেশে অনেক জিনিসই কিনতে পাওয়া যায়। সার্টিফিকেট কেনা বেচা তো হয়ই। রেজাল্ট, সার্টিফিকেট এমনকি মনুষত্ব পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় এদেশে। আবার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কেউ কেউ।
ভাবা যায় একটি দেশের সর্বো”চ মানুষ যারা তৈরি করবে তারা নিজেরাই মুনষ্যত্বহীন! তারা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে তারপর শিক্ষক হতে চায়। এরা ছাত্রছাত্রীদের কী শিখাতে পারে? শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেটধারী কত শিক্ষক তো চাকরি হারিয়েছেন। যাদের নিজেদেরই মনুষ্যত্ব নেই তারা আবার ছাত্রদের শেখাবেন।
আজকাল তো কত নামজাদা শিক্ষকের গবেষনাও নকল প্রমাণিত হচ্ছে ! মানে ধার করা আরকি! মনুষ্যত্ব বিক্রি করে দিব্বি চোখ বুঁজে চাকরি করে যাচ্ছে সারাজীবন। প্রশ্ন ফাঁস করে যারা এতকাল ভালো রেজাল্ট করেছে তারা তো বহাল তবিয়তে দেশের বড় আদৌ দেশের উন্নয়ন চায় বলে মনে হয় না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবেমাত্র পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সেই পরিবর্তন হচ্ছে সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখেই। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের সেই পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে বা গ্রহণ করতেই হবে। প্রচলিত পরীক্ষা, নম্বর পাওয়া এবং পাস-ফেল এই করতে করতে আমাদের একটি প্রজন্মকে আমরা প্রায় পঙ্গু করে রেখেছি।
মেধা শব্দটিকে ইংরেজি, গণিত বা বিজ্ঞানের মতো কঠিন সাবজেক্টে দক্ষতার মধ্যে আটকে রেখেছি। মনের সুপ্ত ই”ছাগুলো মনের ভেতরেই মরে গেছে। সত্যি বলতে, আমরা প্রচলিত শিক্ষা দিয়ে কিন্তু মানুষ করতে পারিনি। তাই এই পরিবর্তন আবশ্যক ছিল। একদিন তা সকলের জন্যই শুভ ফল বয়ে আনবে।
তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরের দেশের সাথে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য দেশের বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে সমান মান বজায় রেখে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখা:-প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
পাবনা।
[”মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”]
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/০৪/০৫/২৪