এইমাত্র পাওয়া

ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন ও কিছু ভাবনা

শাহাবুদ্দীন ।।

প্রাথমিক শিক্ষাই সব শিক্ষার ভিত্তিভূমি। বিষয়টি সবার আগে জাতির জনক ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন। তাইতো তিনি ১৯৭৩ সালে একই দিনে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাও একইভাবে তার গত শাসনামলে কয়েক দফায় ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছেন এবং তার সরকারের সময়েই বিদ্যালয়বিহীন ১৫০০টি গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ শেষ করছেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করার জন্য দেশের প্রতিটি গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয়।

তবে শুধুমাত্র বিদ্যালয় সরকারি করে বা নতুন সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন করলেই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। প্রাথমিক শিক্ষার উচ্চমান রক্ষার্থে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষক। একমাত্র যথাযথ টিচার এডুকেশনই নিশ্চিত করতে পারে স্ট্যান্ডার্ড প্রাইমারি টিচার্স। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের (বর্তমানে প্রশিক্ষণ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে শিক্ষক-শিক্ষণ পরিভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে) ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে ইংরেজ পণ্ডিত উডের ডেসপাচের সুপারিশ অনুসারে অবিভক্ত বাংলায় গ্রেডেড স্কুল পদ্ধতির সূচনা হয়। সে সময় প্রাথমিক শিক্ষা নিম্ন প্রাথমিক (১ম+২য় শ্রেণি) এবং উচ্চ প্রাথমিক (৩য়+৪র্থ শ্রেণি) ধারায় বিভক্ত ছিল। সে সময়কার প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কথা কেউ ভাবেননি। এ থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে অবহেলার বহু পুরনো চিত্র সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। পরবর্তীতে ১৯০২ সালে সর্বপ্রথম গুরু ট্রেনিং (জিটি) স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। যথার্থ নামই বটে! প্রাথমিক শিক্ষকরাই তো আদতে সবার শিক্ষাগুরু! দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মূল্যায়ন ভিন্ন হতে পারে। সে অন্য কথা। যাহোক, জিটি স্কুলে দুজন ম্যাট্রিক পাস ভিএম (ভার্নাকুলার মাস্টারশিপ) শিক্ষক দায়িত্ব পালন করতেন।

কর্মরত শিক্ষকদের একজনের পদবি ছিল হেড পণ্ডিত এবং অন্যজন সহকারি পণ্ডিত। তখনকার শিক্ষকদের কম শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনায় প্রশিক্ষণে তাত্বিক আলোচনা খুবই কম থাকতো। বরং হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিক্ষকদের শেখানো হতো। ১৯৪৪ সালে ৫৫টি জিটি স্কুলকে প্রাইমারি ট্রেনিং (পিটি) স্কুলে রূপান্তর করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি নতুন প্রাইমারি ট্রেনিং (পিটি) সেন্টার চালু করা হয়। এ সব স্কুলের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি জিটি স্কুলের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির মতোই ছিল। তবে পিটি স্কুলগুলোতে বিটি ডিগ্রিধারী একজন গ্রাজুয়েট শিক্ষক থাকতেন। আর নির্বাচিত হাই স্কুলে স্থাপিত পিটি সেন্টারগুলোর দায়িত্বে থাকতেন সংশ্লিষ্ট হাই স্কুলের হেড মাস্টার। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে পিটি স্কুল ও পিটি সেন্টারের সংখ্যা ছিল ৮৬টি। এ সব স্কুলের প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি ১৯৪৯-এর সুপারিশ অনুযায়ী প্রচলিত প্রশিক্ষণ স্কুলের পরিবর্তে প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

১৯৫১ সালে পিটিআই স্থাপনের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৫টি সরকারি পিটিআই এবং ২টি বেসরকারি পিটিআই রয়েছে। সত্তরের দশকে পিটিআইসমূহে ৯ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু ছিল। পরবর্তীতে পিটিআইসমূহে এক বছরমেয়াদি সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন (সি-ইন-এড) কোর্স চলে আসছিল। এক পর্যায়ে দেখা গেল চলমান সি-ইন-এড কোর্সও কাঙ্খিত মানের শিক্ষক-প্রশিক্ষণ প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা শেষে দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সি-ইন-এড কোর্সটিকে বদলে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স প্রবর্তন করা হয়। শিক্ষক, প্রশিক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে কোর্স বিষয়ক ধারণাপত্র তৈরি করা হয় এবং একজন বিদেশি পরামর্শক এবং তিনজন দেশীয় পরামর্শকের বিশেষজ্ঞ দল ডিপিএড কোর্সের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেন। এ কোর্সের ভিত্তি হচ্ছে মনোবিজ্ঞানের গঠনতত্ত্ববাদ। শিক্ষণলাভের ক্ষেত্রে তত্ত্বটি অতি আধুনিক ও কার্যকরী।

২০১২ সালের জুলাই থেকে দেশের ৭টি বিভাগের ৭টি পিটিআইতে পরীক্ষামূলকভাবে ডিপিএড কোর্সটি চালু করা হয়। ২০১৫ সালে দেশের অর্ধেকেরও কম পিটিআইতে ডিপিএড কোর্স চালু করা হয়। ডিপিএড কোর্সের মেয়াদ ১৮ মাস। এর মধ্যে ১২ মাস পিটিআইতে অবস্থান করে শিক্ষকদের শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়। শেষের ৬ মাস শিক্ষকরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করেন। গাঠনিক ও সামষ্টিকভাবে কোর্সটির মূল্যায়ন করা হয়। বিদ্যালয় ভিত্তিক বিষয় শিখন-শেখানোর কৌশল ছাড়াও ডিপিএড কোর্সে পেশাগত শিক্ষার অংশ হিসেবে সিমুলেশন, ব্রেইনস্টর্মিং দলীয় কাজ, কার্যোপযোগী গবেষণা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন ফলাবর্তন এবং শিক্ষা বিজ্ঞানের ওপর শিক্ষা দেয়া হয়। বিষয়গুলো অত্যন্ত সময়োপযোগী ও কার্যকরী। এ তো গেল ডিপিএড কোর্সের শিক্ষাক্রমের চিত্র। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কেমন হচ্ছে?এবং যে সকল শিক্ষকগণ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাদের বিষয়ে মন্ত্রণালয় কি কি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে? আসুন জানার চেষ্টা করি।

ডিপিএড কোর্সের প্রশিক্ষক শেষে বাস্তবায়ন, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সংযোগ সীমিত। নিয়োগের পরই ডিপিএড কোর্স সম্পন্ন করে বিদ্যালয়ে যোগদান করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ডিপিএড বিষয়টি তাত্ত্বিক এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা। এখানে সর্বোচ্চ ২০ জন শিক্ষার্থীর বাইরে একজন শিক্ষকের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট পিরিয়ডে কোনোক্রমেই এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ডিপিএড কোর্স সম্পন্নকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারীদের বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পিটিআই/ইউআরসিতে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দিলে প্রাথমিক শিক্ষার মান নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে। ৯-৫টা প্রশিক্ষণকাল, সকালের ব্যায়াম এবং ৯০ মিনিটের লেকচার ক্লাস একজন শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত ক্লান্তিকর।

এতোগেলো বাস্তবায়নে কথা, এবার আসা যাক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের কথায়, আনন্দের সহিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককেরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে সার্টিফিকেট জমা দিলে তাদের বেতন কমে যায় এটি হতাশা জনক।কোন বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে বেতন ভাতার সুবিধা বাড়ে কিন্তু ডিপিএড প্রশিক্ষণ শেষে কমে যায়,এটা শিক্ষকদের মনে চরম ক্ষোভের। তাদের চাওয়া মানসন্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিতে হবে।শিক্ষকদের সকল সম্মানজনক বেতন স্কেল প্রদান করলে মানসন্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে।

আমরা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন চাই। চাই আমাদের গুরু প্রাথমিক শিক্ষকদের মান ও পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের মতে, ডিপিএড কোর্সটিকে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই বিএড পর্যায়ে উন্নীত করা হোক। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। স্নাতক ডিগ্রিধারী ছাড়াও কিছু সংখ্যক শিক্ষককে ডিপিএড কোর্সে ভর্তি করা হয়েছে। বিষয়টি মোটেও কাম্য নয়। এর সমাধান হিসেবে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের বিএড মানের ডিপিএড সনদ দেয়া যেতে পারে। আর নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে যারা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন তারাও বিএড সমমানের ডিপিএড ডিগ্রি পাবেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকরা হতাশা ও ক্ষোভের মধ্যে আছেন। হতাশা আর যন্ত্রণা নিয়ে আর যাই হোক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভালো কিছু অর্জন করা যায় না। কাজেই জাতীয় স্বার্থেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে আশা করি। আর ডিপিএড কোর্সের ফলপ্রসূ বাস্তবায়নে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এপেক্স প্রতিষ্ঠান আইইআর-এর স্বনামধন্য অধ্যাপকদের নিবিড় তদারকির কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেপ-এর ভূমিকা বলার অপেক্ষা রাখে না। জিটি হতে সি-ইন-এড হয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষা কার্যক্রম আজ ডিপিএড নামে পরিচিত। আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না হলে নিছক নাম পরিবর্তন হবে অর্থহীন। পাশাপাশি কোর্সটির সফল বাস্তবায়ন ও ফলাবর্তনের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন শিক্ষক, শিক্ষক-প্রশিক্ষক, শিক্ষা-প্রশাসক এসএমসি এবং সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট ক্যাচমেন্ট এরিয়ার সর্বস্তরের জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন।

লেখক-
সহকারী শিক্ষক,
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.