এইমাত্র পাওয়া

মানন্নোত শিক্ষাবিহীন, জাতীয় উন্নয়ন অর্থহীন

মোঃ সাইদুল হাসান সেলিম।।

পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। আয়তনে বাংলাদেশ ৯১তম এবং জনসংখ্যার ঘনত্বে ৮ম। দারিদ্রতা, সীমিত সম্পদ, অনুন্নত অবকাঠামো দুর্নীতি, নৈতিকতার অবক্ষয়, শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখনও দেশের ২৯% মানুষ নিরক্ষর। ক্ষমতাসীন ধারাবাহিক সরকারের আন্তরিকতায় শিক্ষার পরিমাণগত অগ্রগতি হলেও শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশকে মাধ্যম আয়ের দেশের মানদণ্ডে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন শিক্ষার মানোন্নয়ন। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা টিভি অনেকগুলো উপাদানের একটি হতে পারে।

শিক্ষা টিভিই যে শিক্ষার মানোন্নয়নের অন্যতম উপাদান এমনটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। আর শিক্ষার মানের উন্নতি করতে হলে চাই শিক্ষানীতির পুরোপুরি বাস্তবায়ন। অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতি -২০১০ গুণে মানে সেরা। কিন্তু জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে যে সামান্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা দিয়ে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। জাপানে একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন-ভাতা সুযোগ সুবিধা আমাদের দেশের তুলনায় প্রায় দশ গুণ বেশি। আমাদের দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হলে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণ করে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিতে হবে। এই বোধ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যত দ্রুত জাগ্রত হবে, শিক্ষার গুণগত মান ততোই তরান্বিত হবে বলে বিশ্বাস করি।

আমাদের শিক্ষায়তনে আমরা যা শিখছি, তার নির্যাসটুকু কিন্তু ফিরিয়ে দিচ্ছি সমাজেই। শিক্ষা এমন এক কর্মকাণ্ড যা মানুষের আচরণের বাঞ্ছনীয় পরিবর্তন ঘটায়। মানহীন, নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নের পথে সহায়ক নয়, অন্তরায়। শিক্ষার্থীদের আচরণগত ও কাংখিত পরিবর্তন আনতে পারেন শিক্ষকরাই। অথচ বিভিন্ন বঞ্চনা বৈষম্যের কারণে দেশের শিক্ষকদের শ্রেণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা বাঁ আন্তরিকতা ব্যপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

শিক্ষকগণ কেন প্রাইভেট, টিউশনি ও কোচিং করাতে হয়? এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। মূলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা কোন স্তরেই শিক্ষার নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। উন্নত দেশ থেকে ধার করা আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি, সময় সময় পরিবর্তিত পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাক্রম এসব এলোমেলো করে দিচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে। শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং সেন্টার সম্পর্কে অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে কোচিং বাণিজ্য শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর হলেও অধিকাংশ শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাই অবিলম্বে শিক্ষকদের জীবন মানোন্নয়নে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা জরুরি পরেছে।

মূলত শিক্ষাকে কেন্দ্র করে একটা জাতির যে আশা আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান থাকে বাংলাদেশ তা কোনভাবেই পূরণ করতে পারছে না। ফলে তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নধারা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ২০১৮ সালে বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো আধুনিক ও প্রাযুক্তিগত শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কো বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরির উপর গুরুত্বারোপ করেছে। ৪৯ বছরেও দেশের রাজনৈতিক স্থিরতা ও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করা উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি।

স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হলে, আরো বহু পূর্বেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা সহজতর ছিল। বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়নের সাথে সাথে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে জাতীয় উন্নয়ন সহজতর হতো। দেশ স্বাধীনতার পরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করা হলেও দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতার কারণে তা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেনি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূর করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ও এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে বিশ্ব মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা অবশ্যই সম্ভব হবে।

সদ্য সমাপ্ত ডিসি সম্মেলনেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে কতিপয় সুপারিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যেমন, শিক্ষা টিভি, জেলা উপজেলায় পরীক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ, প্রশ্নপত্র পরিবহনের জন্য গাড়ি এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ বেতন ভাতা দেয়া সত্ত্বেও নামে কেন বেসরকারি ? এমন প্রশ্ন অবশ্যই যৌক্তিক। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারিকরণ করা হলে শিক্ষকদেরকে নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি নির্দেশনা প্রতিপালনে বাধ্য করা সম্ভব হতো।

অপরদিকে শিক্ষকদের অবাধে প্রাইভেট কোচিং,ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে বিরত রাখা যেত। দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষকরা পাঠদানে অমনোযোগী থাকে এবং দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকে। শিক্ষাব্যবস্থার এমনি বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষা( দ্বাদশ শ্রেণি) সরকারিকরণের মাধ্যমে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য এবং রাজনীতি বন্ধ করা হবে, সেই প্রত্যাশায়।

লেখক-সভাপতি
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.