এইমাত্র পাওয়া

মানুষ গড়ার কারিগররা প্রেসক্লাবে কেন ?

।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান ।।

শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর, জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষকে ভালোবেসে অকৃপণভাবে মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে শিক্ষক।জীবনে সফলতার পেছনে যার দক্ষতা ও দিকনির্দেশনা থাকে তিনি হচ্ছেন শিক্ষক। সূর্যের মতো বিলিয়ে যান জ্ঞানের ভাণ্ডার। কালের বিবর্তনে শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র বদলেছে সত্যি, তবে কমেছে গুণগত মান। মুখস্ত আর জিপিএ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা আটকে গেছি। বাড়ছে নম্বরের বোঝা তবে কমছে প্রকৃত শিক্ষা।

এটার জন্য শিক্ষকসমাজ যেমন দায়ী, তেমনি সরকারের কর্তারা বেশী দায়ী। যেমন বৈশম্যতা ও অন্ধরাজনৈতিক দালালপিনা। সরকারী, বেসরকারী, আধাসরকারী,এমপিও , ননএমপিও ,স্বৃকৃতি প্রাপ্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। এক আজব কারবার এ যেন এক মগের মুল্লুক। 

একটি জাতির সুনাগরিক তৈরিতে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সমাজ তথা রাষ্ট্রে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য কে না জানে এই নির্মম সত্য বাক্যটি। 

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সমাজই আজ সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। তাদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও জীবিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, তা শুধু শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং পুরো জাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্তরায়।

একটি জাতির উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের প্রতি বঞ্চনা ও অবহেলার চিত্র আরও বেশি সুস্পষ্ট। ঘুণে ধরা এ সমাজে শিক্ষক শ্রেণির অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বাংলাদেশে শিক্ষকদের প্রতি অবহেলার পেছনে বহু কারণ নিহিত।  শিক্ষকের পেশাকে পেশাগতভাবে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।   শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল, ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি এ পেশায় আসতে আগ্রহ হারান।

 শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব প্রকট।  শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও অবনতি ঘটেছে। একসময় শিক্ষকরা সমাজের সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন। কিন্তু বর্তমান বাণিজ্যিকীকৃত শিক্ষাব্যবস্থা তাদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে।

 বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অধিকার বাস্তবায়নের প্রধান কারিগরদের জন্য কোনো সুসংহত নীতিমালা বা আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি।  উন্নত দেশগুলোয় শিক্ষা খাতে জিডিপির চার থেকে ছয় শতাংশ ব্যয় করা হয়, অথচ বাংলাদেশে এই হার দুই শতাংশের নিচে। এতে প্রমাণিত হয়, শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি শিক্ষকদের উন্নয়নে রাষ্ট্র যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে না।

সব মিলিয়ে শিক্ষকদের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবহেলার চিত্র জাতির ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ‘শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো শিক্ষক,’ এই সত্যটি উপেক্ষা করে কোনো জাতিই টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) চতুর্থ লক্ষ্য হলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু শিক্ষকদের মানসম্মত কাজের পরিবেশ, প্রশিক্ষণ ও ন্যায্য সম্মান না দিলে এই লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব।

অতএব শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা দূর করতে হলে রাষ্ট্র ও সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের পেশাগত উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে তারা যুগোপযোগী শিক্ষাদানের পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেন। শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে মানসম্মত শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের প্রতি যেকোনো অন্যায় আচরণ প্রতিরোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। 

স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তির দাবিতে টাকা নবম দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীরা।তারা বলছেন, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে অযৌক্তিক এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলো। তাই অবিলম্বে আমাদের দাবি মানতে হবে। এবার প্রেসক্লাবের দিকে মনোযোগ দিই। প্রায় ১০ দিন একটানা কর্মসূচি পালন করছেন ননএমপিও শিক্ষকরা। বিশেষ করে রমজানের সময় খাওয়া দাওয়া সেহরি ইফতার নিয়ে কি যে অস্বস্তিতে আছে ননএমপিও শিক্ষকরা।

 গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রায় পুলিশ বাধা দেয়। তবে স্বারকলিপি দিতে পেরে কিছুটা হলেও আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন ননএমপিও শিক্ষক সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক প্রিন্সিপাল মো: সেলিম মিয়া। প্রধান সমন্বয়ক প্রিন্সিপাল মো: সেলিম মিয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তি করতে হবে। তারা বলছেন, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে অযৌক্তিক এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলো। তাই অবিলম্বে আমাদের দাবি মানতে হবে। এ দাবি পূরণ না হলে রাজপথ ছাড়বেন না শিক্ষক-কর্মচারীরা।

তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে অযৌক্তিক এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও বঞ্চিত করেছে। অথচ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ২০-২৫ বছর ধরে এমপিওবিহীন থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক-কর্মচারীরা নিরলসভাবে পাঠদান কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন এবং জাতীয় শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে এমপিও থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের এবং শেখ পরিবারের নামে যেসব প্রতিষ্ঠান ছিলো সেগুলো এমপিওভুক্ত করেছেন, বলেন তারা।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে, তারা এক বা একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু সেই কমিশনের সুপারিশ বা নীতি বাস্তবায়নের আগেই সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। তারা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সময় পায়নি। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভাগ্যবান বলতে হবে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণার পর ১০ বছর সময় পেয়েছে তারা। দুর্ভাগ্য হলো এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষানীতির মৌলিক কোনো ধারাই বাস্তবায়িত হয়নি। কাঠামোগত সংস্কার হয়নি, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন হয়নি। নীতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন হয়নি।

সরকার নতুন করে শিক্ষানীতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বলা হয়েছে শিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করা হবে। আসলে শিক্ষা নিয়ে কাজের চেয়ে কথাই বেশি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।সেলিম মিয়া বলছেন যেহেতু অরাজনৈতিক সরকার ইনশাআল্লাহ আমাদের ন্যায্য দবিী পুরন হবে ইনশাআল্লাহ। আমরাও আশাবাদী ন্যায্য দবিী পুরন হোক।

শিক্ষা হলো অনেকটা বহুতল ভবনের মতো। এর ভিত যত শক্ত হবে, ওপরে তলাও তত বাড়ানো যাবে। কিন্তু অতীতের মতো বর্তমান সরকারের আমলেও শিক্ষকরা  উপেক্ষিত হচ্ছে । শিক্ষক যে ন্যায্য দাবী নিয়ে প্রেসক্লাবে আছে সেখান থেকে শিক্ষকরা বাড়ি যেতে চাই তাদের প্রাপ্য নিয়ে। সকল শিক্ষক মনে করে অচিরেই সরকার দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবে এবং শিক্ষকদের হ্দয়ে  অবস্থান করবে। 

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।

শিক্ষাবার্তা /এ/০৩/০৩/২০২৫

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.