নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ স্বৈরিচারী শেখ হাসিনা পতনের ঠিক এক দিন আগে পেশাজীবীদের (ইঞ্জিয়ার) নিয়ে গণভবনে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সেই বৈঠকে প্রথম সারিতে উপস্থিত ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবু তালেব। তিনি রাজধানীর টি এন্ড টি কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। আর সেই সভাপতি টি এন্ড টি কলেজের অধ্যক্ষ পদে কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিয়োগ দেন তারই নিকটজন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম সহযোগী অধ্যক্ষ নূর হোসেনকে। ৫ আগস্টের পর সভাপতি আবু তালেব দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও এই সভাপতি কর্তৃক মহাজালিয়াতি করে নিয়োগকৃত ও পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত হওয়া মোঃ নূর হোসেনের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা থেমে নেই। নিজে আওয়ামী লীগের সরাসরি সুবিধাভুগী হয়েও নিজেকে বৈষম্যের শিকার দাবি করে আওয়ামী সুবিধাভোগী কিছু শিক্ষক এবং বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে মানববন্ধন ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচী পালন করাচ্ছেন তিনি। জালিয়াতি করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক মাস আগে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ নেওয়া এবং আওয়ামী আমলে আয় করা কালো টাকা দিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়া নূর হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তের স্বার্থে বর্তমান গভর্নিং বডি কর্তৃক তাকে অব্যাহতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিলেও সেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দেননি তিনি।
এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রি. “কোনো নিয়মই মানা হয়নি টি এন্ড টি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগে তবুও এমপিওভুক্তি” শিরোনামে এবং গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রি. “মতিঝিলের টি এন্ড টি কলেজের সেই অধ্যক্ষ নূর হোসেনকে অব্যাহতি”শিরোনামে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
নিয়োগ জালিয়াতি ও আর্থিক অনিয়ম নিয়ে করা তদন্তের স্বার্থে গত ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে নূর হোসেনকে কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ ছগীর আহমেদ অব্যাহতি দিলেও আজ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝে না দিয়ে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন তিনি।
জানা গেছে, কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি আবু তালেব পতিত হাসিনা সরকারকে রক্ষা করার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের পলায়নের ঠিক দুই দিন আগে অর্থ্যাৎ ৪ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে পেশাজীবীদের গণভবনের বৈঠকে প্রথম সারির চেয়ারে বসে ছিলেন। এই আবু তালেব ২০১৬ সাল থেকে পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর দিন পর্যন্ত কলেজটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কোন বেসরকারি কলেজ যদি কোন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে গভর্নিং বডির সভাপতি পদে ঐ সংস্থা কর্তৃক লিখিতসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেওয়ার শর্ত উল্লেখ রয়েছে। টি এন্ড টি কলেজ বিটিসিএল কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। বিটিসিএল এর এডিশনাল ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে সভাপতি আবু তালেব ২০১৬ সালে কলেজটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এবং ২০২০ সালে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হয়ে অবসরে চলে যান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী অবসরে গেলে এই পদে থাকার কোন বৈধতা না থাকলেও তথ্য গোপন করে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এই কমিটির মেয়াদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে শেষ হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত না করে ৩০ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি কর্তৃক ২২ মার্চ ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দে অধ্যক্ষ পদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরিপত্র/প্রজ্ঞাপন মোতাবেক বেসরকারি কলেজে এনটিআরসিএর প্রবেশ পর্যায়ের পদ বাদে নিয়োগে বৈধ কমিটি অবশ্যই থাকতে হবে। এছাড়াও নিয়োগে কোরাম পূরণ না করা, ৫৫ এর অধিক বয়সী একাধিক প্রার্থীকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া, লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া, বেশ কয়েকজন বৈধ প্রার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়াসহ আওয়ামী ছত্রছায়ায় এই নিয়োগে কোন নিয়মনীতিই মানা হয়নি।
সম্প্রতি কলেজটির কতিপয় শিক্ষক যারা আওয়ামী সরকারের সরাসরি উচ্ছিষ্ট ভোগী অর্থ্যাৎ কলেজটির সাবেক সভাপতি আবু তালেব ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়টাতে সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে এই কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি এবং গভর্নিং বডি কর্তৃক সুবিধাভোগী তারা সম্প্রতি নূর হোসেনকে পুনর্বহাল এবং পাঁচ আগস্টের পর কলেজটিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোঃ ছগীর আহমেদ এবং বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী মুহাম্মদ মাইন উদ্দীনকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। সম্প্রতি আওয়ামী সুবিধাভোগী এই শিক্ষকরা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষকবৃন্দের ব্যানারে কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে স্বৈরাচারের দোসর উল্লেখ করে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। অথচ জুলাই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে গোনা যে কয়জন শিক্ষক সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছিলেন এবং রাজপথে সরব ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক ড. মোঃ ছগীর আহমেদ। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী মুহাম্মদ মাইন উদ্দীন বিএনপির পেশাজীবী সংগঠন জিয়া পরিষদ এবং শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য জোটের একজন বর্ষীয়ন নেতা। যিনি স্বৈরাচারী হাসিনা পতনের দাবিতে দেড় যুগ ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছেন এবং শিক্ষকদের সংগঠিত করেছেন।
কলেজটির একাধিক শিক্ষক বলছেন, নূর হোসেন নিয়োগ জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ পদে বসার পর এমপিওভুক্ত হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নামে বেনামে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এমপিওভুক্তিতে মোটা অংকের টাকা ঢেলেছেন। তিনি যে অপকর্ম করেছেন তা ঢাকতে বর্তমান তার বিরুদ্ধে করা তদন্তের তদন্তকাজে বাঁধা গ্রস্থ করতে সভাপতির নামে মিথ্যা প্রপ্যাগান্ডা চালাচ্ছেন। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আস্তাভাজন কলেজটির সাবেক সভাপতি আবু তালেব শেখ হাসিনা পালনের ঠিক দুই দিন আগে গণভবনের মিটিংয়ে সম্মুখ সারিতে বসে ছিলেন। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন আমরা কেউ জানিনা। আওয়ামী সেই দোসরের হাতে সম্পূর্ণ জালিয়াতি করে নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ নিজেকে বর্তমানে বৈষম্যের শিকার দাবি করছেন যা শুধু হাস্যকরই নয় জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের সাথে বৈঈমানি।
জানতে চাইলে আওয়ামী সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ হওয়া এবং তদন্তের স্বার্থে অব্যাহতি পাওয়া অধ্যক্ষ নূর হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেন নি।
জানতে চাইলে কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ ছগীর আহমেদ শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, বিধি মোতাবেক যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমেট অনুযায়ী দুইজন প্রতিনিধি দিয়েছেন। তদন্ত কার্যক্রমের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যেই কলেজটি তদন্ত দলের সদস্যরা উপস্থিত হয়ে সরেজমিনে তদন্ত করবেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুলেটের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে যে কয়জন শিক্ষক ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাজপথে সরব ছিলেন তাদের মধ্যে আপনি অন্যতম। এরপরও টি এন্ড টি কলেজের আওয়ামী সুবিধাভোগী কিছু শিক্ষক আপনাকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে আপনার পদত্যাগ দাবি করছেন বিষয়টি কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি, আমি সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক আমাদের অবদান কি সেটা আপনারা মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাই দেখেছেন। এটার বিবেচনা আপনারাই করবেন। কেউ কিছু বলে দাবি হয়ত করতে পারে সেটা সঠিক নয়। তারা হয়ত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এসব করছেন।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৮/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.