এইমাত্র পাওয়া

সচিবালয়ে কঠোর হচ্ছে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক।।আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পৌনে চার মাসেও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে স্থিতিশীল কর্মপরিবেশ ফেরেনি। বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ-সমাবেশ বা কোনো কর্মকর্তার অফিস ঘেরাওয়ের ঘটনা লেগেই রয়েছে।

৯ দফা দাবি আদায়ে সচিবালয়ের ভেতরে সমাবেশ ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী বুধবার মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সমাবেশ থেকে সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর মহাসমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই কর্মসূচির সমালোচনাও করেছেন অনেকে। সাবেক ও বর্তমান একাধিক সচিব বলছেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধরনের কর্মসূচি সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কারণে সরকারও বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না এবং এ কর্মসূচির বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সচিবালয়ে নিজ দফতরে অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে গত পৌনে চার মাস ধরে পদোন্নতি ও ভালো পদায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি কোনো কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার কক্ষের সামনে বিক্ষোভ করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ। এর আগে ডিসি পদায়নকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনায় কয়েকজন উপসচিবকে লঘুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।

পতিত স্বৈরাচারের আমলে চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে আরোপিত সব আদেশ প্রত্যাহার ও ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা প্রদানসহ নিয়মিত চাকরির ন্যায় ভূতাপেক্ষভাবে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার নির্দেশদান, কর্মচারী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় পে-কমিশন গঠন ও বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, ন্যায়বিচার ও সমতার ভিত্তিতে বিদ্যমান ২০টি গ্রেডের পরিবর্তে ১০টি বেতন গ্রেড নির্ধারণ করা, পূর্ণাঙ্গ পে-কমিশন বাস্তবায়নের পূর্বে সব স্তরের কর্মচারীর জন্য ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বাস্তবায়ন এবং ২০তম গ্রেডে (অফিস সহায়ক) কর্মরতদের বেতন গ্রেড ১৭তম গ্রেডে উন্নীত করাসহ ৯ দফা দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে সচিবালয়ের ভেতরে সমাবেশ করছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ।
সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের কর্মসূচি ও আচরণ শুধু সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘনই নয়, সাধারণ জনগণকে সরকারি সেবাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশের দাপটে সচিবালয়ের কর্মপরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করা নিয়ে। আনসার সদস্যরা আন্দোলনের নামে সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশের পর সরকার আদেশ জারি করে সচিবালয়ের বাইরে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেও সচিবালয়ের ভেতরের কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাপটে সচিবালয়ে অস্বাভাবিক কর্মপরিবেশ বিরাজ করছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় অসদাচরণ বলতে অসংগত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী কর্মস্থলে অসদাচরণ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো কিছু পাওয়ার দাবিতে কোনো কর্মকর্তার দরজায় আঘাত করলে, গলা উঁচিয়ে তার সামনে দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে তা উপস্থাপন করা অসদাচরণের শামিল, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অসদাচরণ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। চাকরিবিধি অনুযায়ী কাজের প্রতি অবহেলাও একজন সরকারি কর্মচারীর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অফিস সময়ে নিজ দফতরে অনুপস্থিত থেকে নিজের বা সমষ্টিগত দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য যেকোনো মুভমেন্ট কাজের প্রতি অবহেলা বলে বিবেচিত হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার যেকোনো কৌশল দণ্ডনীয় অপরাধ। তার মতে, দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন দাখিলই একমাত্র পথ। এ ক্ষেত্রে বিক্ষোভ মিছিল করা, অফিস সময়ে দফতরে অনুপস্থিত থাকা, কোথাও বিশৃঙ্খলা করা সরকারি চাকরিবিধিতে অপরাধযোগ্য কাজ।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে যেকোনো উদ্দেশ্যে সরকারকে চাপে রাখার যেকোনো কৌশলই অপরাধ। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে দফতরে অনুপস্থিত থাকাটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। সম্প্রতি যারা এসব কাজে যুক্ত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সচিবালয়ের ভেতরে মহাসমাবেশের ডাকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া থাকলে তা পূরণের জন্য নির্দিষ্ট সময় দিয়ে তারা প্রথমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে পেশ করবে। কিন্তু দাবি আদায়ের নামে অফিস সময়ে সচিবালয়ের ভেতরে সমাবেশ করতে পারে কি না তা ভেবে দেখা উচিত। কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলে সে ক্ষেত্রে আচরণবিধি মেনে করা উচিত। সচিবালয়ের ভেতরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহাসমাবেশ করার নিয়ম রয়েছে কি না বা কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের নেতারা বলছেন, তারা তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। তারা যেহেতু সচিবালয়ে চাকরি করেন তাই সমাবেশ করতে হলে তো সচিবালয়ের ভেতরেই করতে হবে। বাইরে তো আর সমাবেশ করবেন না। অফিস সময়ে সমাবেশ করলে চাকরিবিধি লঙ্ঘন হবে না বলেও দাবি করেন তারা। সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তারা কর্মসূচি দিয়েছেন। দাবি আদায়ে তারা মাঠে আছেন।

তিনি বলেন, নন-ক্যাডার পদ থেকে উচ্চ পদে (সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্মসচিব) পদোন্নতির জন্য পদ সংরক্ষণের দাবি তারা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সবশেষ সভার কার্যবিবরণীতে অর্থ বিভাগের সদস্য ছাড়া বাকি ১০ জন সদস্য স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু অর্থ বিভাগের সদস্য যুগ্মসচিব নাদিরা সুলতানা কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর না করে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করেন। তাই তারা দ্রুত এর সমাধান চান।

শিক্ষাবার্তা /এ/০১/১২/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.