ঢাকাঃ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশে বিভিন্ন খাতে একের পর এক বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে রাজধানীর উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা চলছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ-সংঘাতে জড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নাশকতায় জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও পড়েছেন বিপাকে। এ জন্য দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। অথচ এসব সংঘাতে জড়িত শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনকারী। সেই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীরা সেসব বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কাজ করেছেন। যা সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু হঠাৎ ‘অশান্ত’ হয়ে উঠতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে এসব শিক্ষার্থীর লাগাম কার হাতে?
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করায় সাধারণ মানুষের যেমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তেমনি শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। তাতে করে বিঘ্নিত হচ্ছে পড়াশোনা। আবার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ঐক্য ধরে রাখতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে ছাত্রনেতাদের। যদিও সংঘর্ষে না জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার।
শিক্ষার্থীদের সংঘাত ছাড়াও বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাস্তাঘাট বন্ধের মতো ঘটনাকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ে চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে যেমন তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্র ও উসকানি রয়েছে তেমনি আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা রয়েছে। আবার আন্দোলনে সমন্বয়কদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সমন্বয়হীতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যাকে পুঁজি করে কুচক্রী মহল উঠে পড়ে লেগেছে। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশ অন্যদিকে চলে যাবে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। একই সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের আরও বেশি সতর্ক ও সচেতন হওয়ার পরামর্শ। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয়ের দাবিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি বড় সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। তাদের আন্দোলনে অভ্যন্তরীণ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসেন। ধারাবাহিকভাবে কয়েক দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করার পর সমস্যা নিরসনে কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে আন্দোলন-কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের দাবিতে গত ১৮ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করলে রাজধানীজুড়ে চরম যানজট সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা ট্রেনে পাথর মারে। এতে পাঁচটি কোচের জানালার ২৯টি কাচ ভেঙে যায়। আর কয়েকজন যাত্রী আহত হন। এক পর্যায়ে তিতুমীর কলেজ ‘অনির্দিষ্টকাল’ বন্ধের ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। পরে সচিবালয়ে এক বৈঠকের পর সরকারের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
রাজধানীর ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সায়েন্স ল্যাব ও নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ কলেজের অবস্থান। বিগত কয়েক বছর ধরে স্লেজিং, কথাকাটাকাটি, কটূক্তির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘পান থেকে চুন খসলেই’ বড় ধরনের সংঘর্ষ হচ্ছে কলেজ তিনটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এতে শিক্ষার্থীদের আহত হওয়ার পাশাপাশি রাজধানীবাসীর জনদুর্ভোগেরও কারণ হচ্ছে। ভাঙচুর করা হয় সংঘর্ষের মধ্যে পড়া যানবাহনও। গত ২০ ও ২১ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ সংঘর্ষে জড়ায়। ২১ নভেম্বরের ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ শতাধিক শিক্ষক শিক্ষার্থী আহত হন। এ ঘটনার পর ঢাকা কলেজ একদিন ও সিটি কলেজ তিন দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
গত ২৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। কয়েক দফায় সংঘর্ষের পর মাঝরাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একাধিক টিম।
গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীর ডেমরায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ন্যাশনাল মেডিকেলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এদিন একদল শিক্ষার্থী পুরান ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে হামলা-ভাঙচুর চালায়। এই হামলায় রাজধানীর ৩০-৩৫টিরও বেশি কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন বলে অভিযোগ ওঠে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজে হামলা ও ভাঙচুর করেন। তারপরে এই হামলার পরিশোধ হিসেবে সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজে হামলার ‘প্রতিশোধ’ নিতে পরদিন সোমবার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পাল্টা হামলা, ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। আহত হন কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরাও। এদিন সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় ১০০ জনের বেশি আহত হন এবং কয়েকজন শিক্ষার্থীর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। হামলার সময়ে মোল্লা কলেজের গেট ভাঙচুর করে ভেতরে ঢুকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ার, কম্পিউটার-ল্যাপটপ-ডকুমেন্টসহ মূল্যবান অসংখ্য জিনিস লুটপাট করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সংঘর্ষের ফলে ওই এলাকার সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন দাবি করেন, হামলায় তাদের প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকালে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাসে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম শাহরিয়ার বলেন, কলেজ সহিংসতায় তৃতীয় পক্ষের বা অন্য মানুষদের উসকানি ছিল। আমরা এই তৃতীয় পক্ষকে মনে করছি ইউসিবি নামের একটি সংগঠনকে। এই সংগঠনের প্রতিনিধি ঢাকার সব কলেজেই আছে। মূলত তাদের উসকানিতে এই ধরনের সহিংসতার সূত্রপাত।
কবি নজরুল কলেজের সাজ্জাদ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী সময়ের আলোকে বলেন, যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করা চরম নিন্দনীয় কাজ। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা চরমভাবে আতঙ্কে রয়েছি এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাই দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য দাবি জানাই।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের মিনা বেগম নামের এক শিক্ষার্থীর মা সময়ের আলোকে বলেন, হামলা-ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। কখন আবার জানি হামলা হয়। তাই ছেলেমেয়েদের কলেজে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি।
মঙ্গলবার এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আমরা চাই না ছাত্র ভাইদের কঠোর হয়ে দমন করতে। আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। কলেজের সমস্যা আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। এ জন্য আমাদের শিক্ষকরা রয়েছেন। কারও রাস্তায় নামার প্রয়োজন নেই। রাস্তা ব্লক না করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেও দাবি জানাতে পারে।
আর চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে জনসাধারণকে ধৈর্য ধরা ও শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড প্রোফাইলে এক পোস্টের মাধ্যমে তিনি এই আহ্বান জানান।
সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের হামলা, অবরোধ এবং আন্দোলন প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মহিউদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমান এ পরিস্থিতির জন্য পতিত ফ্যাসিবাদী দোসরদের ইন্ধন থাকতে পারে। তারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক থাকছি।
এসব ঘটনা কেন ঘটছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশেক মাহমুদ সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা হঠাৎ করে হয়নি। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর একটা ষড়যন্ত্রের বিষয় রয়েছে। একটা দল সরকার থেকে সরে গেছে। তারা ক্ষমতা হারানোর পর নানা ইস্যুতে তৈরি করার চেষ্টা করছে। গোপনে গোপনে নেটওয়ার্ক তৈরি করে নানা ইন্ধন জোগাচ্ছেন, মাঠে নামানোর চেষ্টা করছেন এবং ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ড. আশেক মাহমুদ বলেন, ছাত্রদের মিসগাইড করা হচ্ছে। এখন গোয়েন্দা সংস্থার কাজ হলো এগুলো খুঁজে বের করা। তাই ছাত্রদের শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সরকারেরও উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ক্ষমতায়ন করা। আর যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তাদের বহিষ্কার বা টিসি দেওয়া এবং ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৭/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.