নিজস্ব প্রতিবেদক।।প্রথম শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত পাঠ্যবই আটটি। কিন্তু অধিকাংশ নামিদামি স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় আরও দুই থেকে পাঁচটি বই বেশি। অতিরিক্ত বই, ক্লাসের খাতা, স্কেল বাক্স, পানির বোতল, টিফিন বক্স—সব মিলিয়ে স্কুল ব্যাগের ভার বইতে বইতে ছাত্রছাত্রীরা সত্যিই ক্লান্ত।
দিনের পর দিন ছোট ছোট বাচ্চার পিঠে এই স্কুল ব্যাগের বোঝা ক্রমশই যেন বেড়ে চলেছে। রাজধানীর একটি সচরাচর দৃশ্য, ব্যাগের ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটছে শিশু, নয়তো ছেলেমেয়ের ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চলেছেন তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবক। বিভিন্ন নামি স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিশুর ব্যাগের ওজন তিন কেজির বেশি। আবার ইংলিশ ভার্শনে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন গড়ে চার কেজির বেশি। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন পাঁচ কেজির বেশি। এক্ষেত্রে আট বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
একটি শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি তার স্কুল ব্যাগের ওজন হবে না। এটা হাইকোর্টের আদেশ। এজন্য আইন-বিধিমালা প্রণয়নে আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু তার পরও স্কুল ব্যাগের ওজন থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের স্কুল ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি। হাইকোর্টের বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও আশিস রঞ্জন স্কুল ব্যাগ নিয়ে এই রায় দেন ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এ রায়ের পর আইন না করা এবং নির্দেশনা না মানায় সংশ্লিষ্টরা একটি আদালত অবমাননা আবেদনও করেছিলেন। সেটি এখনো শুনানির অপেক্ষায় আছে।
শিশুদের জন্য প্রথম শ্রেণিতে এনসিটিবির পাঠক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত পাঠ্যবই হলো— ইংরেজি, বাংলা, প্রাথমিক গণিত, পরিবেশ পরিচিতি সমাজ ও বিজ্ঞান, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং ধর্ম। তবে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় অতিরিক্ত আরও দুটি বই। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় অতিরিক্ত চারটি বই।
এর মধ্যে বাংলা বিষয়ে দুটি ও ইংরেজির দুটি। অতিরিক্ত চারটি বই ও স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত খাতা, কলম, স্কেল বক্স, পানির বোতল—সব মিলিয়ে ব্যাগের ওজন তিন কেজির বেশি। শুধু প্রথম শ্রেণি নয়, বিভিন্ন শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই রয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে অতিরিক্ত পাঁচটি বই পড়ানো হয়। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলেও পড়ানো হয় অতিরিক্ত বই।
শুধু এ তিনটা স্কুল নয়, ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই বাড়তি বই পড়তে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থীদের। যদিও আইনে এটি নিষিদ্ধ। তার পরও বছরের পর বছর ধরে শিশুদের অতিরিক্ত বই পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রেণিভেদে দুই থেকে পাঁচটি অতিরিক্ত বই পড়ানো হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে কোনো কোনো স্কুল নিজেরা বইয়ের ব্যবসা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল সরাসরি বই বিক্রি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ের দোকান ঠিক করে দেয়, যেখান থেকে সুবিধা পায়। বাড়তি বই পড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যও উত্সাহিত হয়। শিক্ষাবিদরা বলেন, শিক্ষার্থীর বয়স ও বিকাশের কথা বিবেচনা করে পাঠ্যবই ও পাঠগুলো নির্ধারণ করা হয়। এর অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হলে তা ক্ষতির কারণ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম বলেন, দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করা উচিত। শিশুদের স্কুল সময় হওয়া উচিত সকাল ৮টা বা ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। শিশুরা শিখবে, পড়বে, খেলবে এবং দুপুরের খাওয়া-দাওয়া স্কুলেই করবে।
শিক্ষাবিদরা বলেন, কোন শ্রেণিতে কয়টি বই পড়ানো হবে, তা নির্ধারণ করে দেয় এনসিটিবি। সেটি ঠিক করার জন্য শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিও রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দেয় সরকার। এনসিটিবির আইনে বলা আছে, বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত নয় অথবা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদিত নয়, এমন কোনো পুস্তককে কোনো বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, পাঁচ বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ১৮ দশমিক ৭ কেজি, আর মেয়ের ১৭ দশমিক ৭ কেজি। ছয় বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ২০ দশমিক ৬৯ কেজি আর মেয়ের ১৯ দশমিক ৯৫ কেজি। সে হিসাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ অর্থাৎ সর্বোচ্চ দুই কেজি হওয়ার কথা। সেখানে ঢাকার খ্যাতনামা বিভিন্ন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন পাওয়া গেছে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ কেজি। একদিকে বাড়তি বই পড়ার চাপ; অন্যদিকে কোচিংয়ের জন্য চাপ—এসব সহ্য করতে না পেরে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এ/১২/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.