ড. মঞ্জুরে খোদা: বাজেট আসন্ন। বাজেটের আগে পরে আমরা তার ভালো-মন্দ নিয়ে অনেক কথা বলবো। অতপর অতীতের ধারাবাহিকতায় এগুলো হারিয়ে যাবে। সরকারও তার ছকেই চলবে। বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে শিক্ষাখাতে সরকারের বরাদ্দ। সরকার বাজেট ঘোষণার পর যথারীতি বলবেন যে, শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং বাজেটের অংকে আপাত দেখা যাবে আগের বছরের তুলনায় তা সামান্য বৃদ্ধিও পেয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে যে একটা ফাঁকি ও চাতুর্য আছে সে বিষয়টি সামনে আসবে না। কি সেই ফাঁকি? ফাঁকিটা মূলত টাকার অংক, তার মূল্যমান, শিক্ষার খরচ, সরকারি বরাদ্দ, শিক্ষার অবয়ব বৃদ্ধি ও মানের বিষয়টি। সকল শাসকের পক্ষ থেকেই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হলেও তা আসলে অবহেলিত ও গুরুত্বহীনই থেকে গেছে। শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের কথা বলা হলেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। এই বিষয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপন করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে যে, ফাঁকিটা আসলে কোথায় ও কীভাবে?
ইউনেস্কো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশে বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছেন। কয়েক দশক আগে ইউনস্কো যখন এই পরামর্শ প্রদান করেন তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতোটা ভালো ও বড় ছিল না। শিক্ষার হার, ব্যাপ্তি-প্রসারও এতটা ছিলো না। এখন বাংলাদেশের বাজেটের আকৃতি অনেক বড় হয়েছে শিক্ষার খরচ ও বরাদ্দও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় সরকারি বরাদ্দ বাড়েনি। বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে ব্যয়ের বিষয়টি তুলনা করলে যে চিত্র পাওয়া যায় তা যথেষ্ট উদ্বেগের ও লজ্জার। যেমন বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ১৮৯টি সদস্যদেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ প্রদান করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। শিক্ষাখাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানের বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৪ দশমিক ১ এবং ভারত ও পাকিস্তান বরাদ্দ প্রায় ৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে বরাদ্দের দিক থেকে বাংলাদেশ এই দেশগুলোর মধ্যে সবার চেয়ে নিচে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ সালে তা ছিল ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে বরাদ্দ বাড়বে কি দেখা যাচ্ছে তা ক্রমশ কমছে। যদিও শিক্ষার আকৃতি ও খরচ বাড়ছে। সমসাময়িক সময়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল। যা ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এরপর গত ৭ বছরে এই বরাদ্দ কমেছে এবং তা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের পর আফ্রিকার সোমালিয়া, সুদান, কঙ্গো ও উগান্ডা’র মত দরিদ্র দেশগুলো শিক্ষাখাতে সর্বনিম্ন বরাদ্দ করে থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়। এ বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে—১ লাখ ৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এখান থেকে প্রযুক্তি খাত বাদ দিলে শিক্ষার বাজেট দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তাহলে শিক্ষায় টাকার অংকে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও জিডিপি ও শতাংশের হারে তা বাড়েনি। তাহলে কীভাবে তাকে বৃদ্ধি বলা যায়? বছর বছর তো দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে সেই তুলনায় শিক্ষায় বরাদ্দ নেই কেন? তাহলে নীতিনির্ধারকরা শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলে কি জনগণের সাথে মিথ্যাচার ও প্রতারণা করছে না?
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষিতের হার দিনদিন বাড়ছে। সেটা বাড়লে স্বাভাবিক ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর হার-সংখ্যাও বাড়ছে। তাহলে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের অর্থ ভাগ হয়ে যাচ্ছে মানে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় কমে যাচ্ছে, তাই নয় কি? এর সাথে যদি অর্থের অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টি যদি যুক্ত করা যায় তাহলে শিক্ষাখাতে প্রকৃত বরাদ্দ আরো কমে যাবে। এভাবেই জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত শিক্ষা গুরুত্বহীন ও অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। যার পরিণতিতে শিক্ষার মান, অবস্থা ও পরিবেশও নিম্নমুখী হচ্ছে। আমাদের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। মানবসম্পদই আমাদের প্রধানতম ভরসা। আর সেই মানবসম্পদকে ব্যবহার করে উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষায় বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই। গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সদ্য প্রণীত এই শিক্ষানীতি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হলেও একটি বিষয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না সেটা হচ্ছে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশ্নটি। কিন্তু সরকার এখানে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
শিক্ষার উন্নতি করতে হলে প্রাথমিকভাবে যে কাজগুলো করা জরুরি সেটা হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। [১] প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক লাইব্রেরি, ল্যারেটরি, গবেষণাগার, কম্পিউটার ল্যাব থাকতে হবে। [২] শিক্ষার্থীদের খেলাধূলার জন্য উপযুক্ত খেলার মাঠ থাকতে হবে। [৩] মানসম্পন্ন শিক্ষক দরকার। মান সম্পন্ন শিক্ষক পেতে শিক্ষকের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। [৪] সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হলে প্রত্যেক স্কুলে হলরুম বা অডিটোরিয়াম তৈরি করা দরকার। [৫] নতুন শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থীদের রান্নাবান্না ও নানা ধরনের হাতের কাজের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। নতুন এই শিক্ষার ধারাকে বলা হয়েছে, ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক শিক্ষা। সেই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হলে স্কুলগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা সম্বলিত কিচেনরুম তৈরি করা প্রয়োজন। শুধু শিক্ষার একটি নতুন ধারা চালু করলেই মানসম্পন্ন শিক্ষা হয়ে যায় না, এর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষক ও পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
উন্নত বিশ্বের সাথে আমাদের অনেক কিছুর তুলনা করা হয়, কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষার পরিবেশ ও বাস্তবতকাকে সেই পর্যায়ে নিতে যেতে পরিনি। দেশের নীতিনির্ধারকরা সেই চেষ্টা করছেন। আমার এমনটা মনে হয় না। আগামী মাসে মানে আগামী সপ্তাহেই সংসদে নতুন বাজেট হাজির করা হবে। এবার আশা করি সংশ্লিষ্টরা অতীতের ধারাবাহিকতা অনুসরণ না করে শিক্ষার সংকট উপলব্ধি করে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করবেন। শিক্ষকের পেশাটাকে সম্মানের, মর্যাদার ও অতি আকর্ষণীয় না করা গেলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। আর সেটা না হলে শিক্ষাটাও মানসম্পন্ন হবে হবে না। কেননা শিক্ষকের মানের উপর নির্ভর করছে শিক্ষার মান। শিক্ষার সাথে রাষ্ট্র-সমাজ পরিচালনা, উপযুক্ত নেতৃত্ব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নয়নের সম্পর্ক। দেশের কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই যদি উন্নয়নের একমাত্র পরিমাপক বলা হয় তাহলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। নাগরিকেদের মধ্যে উন্নত, রুচি, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ও দেশাত্ববোধ তৈরি করা না গেলে কথিত এই উন্নয়নও টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০২/০৬/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.