এইমাত্র পাওয়া

বন্ধ হোক শিশুশ্রম

ঢাকাঃ বাংলা সাহিত্যের আঠারো শতকের শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায়ের একটি অসাধারণ পঙ্‌ক্তি রয়েছে- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। মা-বাবা সব সময় তাদের সন্তানের জন্য এ মঙ্গল কামনাটিই করে থাকেন। সব অর্থেই সন্তানের জন্য মা-বাবা দুজনই যেন নিবেদিত দুটি প্রাণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বাস্ততবতা বেশ কঠিন।

এই যেমন রোজ সকাল ৯টায় এসে তারকাঁটা কারখানায় কাজ শুরু করে ১২ বছর বয়সি সুমন। খুব সকালে এসে কাজ শুরু করতে হয়, তা না হলে দিনের হাজিরা কাটা যাবে। এ চিন্তায় সুমনও তাই আসতে দেরি করে না। ছোট ও জরাজীর্ণ কারখানায় গিয়ে দেখা গেল ধ্যানমগ্ন হয়ে কালিমাখা জামায় তারকাঁটা তৈরির মেশিনে কাজ করছে সুমন। উচ্চশব্দ ও জরাজীর্ণ এমন পরিবেশে প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরিয়েই দেশের লাখো শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ‘কাম না করলে খামু কী? বাপ নাই। মায়ে কাম করে অন্যের বাড়িত।’ সুমনের উত্তরে জড়িয়ে আছে যেন লাখো শিশুশ্রমিকের ক্ষোভ, হতাশা আর অভিমান। জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ, ভিক্ষাবৃত্তি বা চায়ের দোকান, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করতে বাধ্য হওয়া এসব শিশু প্রতিদিন আঘাত ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

শিশুশ্রমে কেন যুক্ত হচ্ছে শিশুরা, কেনইবা পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুশ্রমকে বাধা দিচ্ছে না অথবা নিরুৎসাহ করছে না? এর অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয়ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) অনুযায়ী, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর অর্থ জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ দরিদ্র, যাদের পক্ষে সন্তানদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে অনেক শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এ শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ আর কিশোরের বয়স ১৪-১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছেÑ১৪ বছরের কম বয়সিদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুর অভিভাবক কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে না।

কিশোর শ্রমিকের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-কাজে নিয়োগ করতে হলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ নিতে হবে, যেটার খরচ বহন করতে হবে মালিককে। কিশোর শ্রমিকদের স্বাভাবিক কাজের সময় হবে পাঁচ ঘণ্টা। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না।

এ আইনে আরও বলা হয়েছে-১২ বছর বয়সি শিশুদের দিয়ে সে কাজগুলোই করানো যাবে যেগুলো তাদের স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করবে না এবং শিক্ষাগ্রহণের অধিকার বিঘ্নিত করবে না।

আইন ও সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা সত্ত্বেও এখনও সমাজে দারিদ্র্যসহ নানাবিধ কারণে শিশুশ্রম রয়ে গেছে। সুনির্দিষ্ট করে বললে গত ১০ বছরে শিশুশ্রম বেড়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২-এর প্রতিবেদন অনুসারে শিশুশ্রমিক বেড়েছে ৮৬ হাজারের বেশি। দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। এ ছাড়া বর্তমান শিশুশ্রমিকের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তবে ১০ বছরের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখের মতো কমেছে।

আমরা যদি শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভাবি, তাদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যারা আছে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প হতে পারে। অভিভাবকরা যাতে এসব শিশুকে নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে লেখাপড়া করাতে পারেন, সেজন্য তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া। স্কুলপড়ুয়াদের দুপুরের খাবার দেওয়াকে এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেখে এই শিশুদের পুনর্বাসন করা। যেকোনো উপায়ে হোক, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে মুক্তি দিতেই হবে।

শিক্ষাবার্তা ডটকম /এএইচএম/০১/০৫/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.