শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ “সবার আগে বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দরকার। বাচ্চাই যদি না বাঁচে, তাহলে পড়বে কারা? বেঁচে থাকলে লেখাপড়া হবে,” গরমে স্কুল বন্ধ রাখা সম্বন্ধে বলছিলেন পটুয়াখালী’র বাউফল উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ আরিফুর রহমান।
মি. রহমানের দুই সন্তানের একজন বাউফলের একটি গ্রামের স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে।
কিন্তু চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ইতোমধ্যেই সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে মি. রহমানের সন্তানদের আপাতত স্কুলে যেতে হচ্ছে না। তবে এর ফলে তাদের পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও খানিকটা চিন্তায় রয়েছেন তার মতো অনেক অভিভাবক।
এমন পরিস্থিতিতে তার মতো অনেক অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, এমনকি সরকারও ভাবছে যে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এগিয়ে আনা প্রয়োজন কি না।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি বর্ষাকালে
বাংলাদেশকে নাতিশীতোষ্ণ দেশ বলা হলেও এপ্রিল ও মে মাস হল বছরের উষ্ণতম মাস। কিন্তু সাধারণত জুন মাসে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেওয়া হয়।
যদিও জুন বা জুলাইয়ে বর্ষা মৌসুম চলায় গরমের তীব্রতা অনেকটা কমে গিয়ে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। এ নিয়ে প্রতি বছর বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও এর কোনও পরিবর্তন হয়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের ছুটির তালিকা অনুযায়ী, চলতি বছরও আগামী ১৩ জুন থেকে দোসরা জুলাই পর্যন্ত ঈদ-উল-আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অথচ, দেশে গত এক মাস ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে, যা গত ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে।
আবহাওয়াবিদরা বারবার বলছেন যে মে’র প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকলেও দেশের কিছু অঞ্চলে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে এবং মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আবার তাপমাত্রা বাড়বে।
এর আগে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের সরকার কর্তৃক ছুটির তালিকা অনুযায়ী, ২০শে জুলাই থেকে দোসরা আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিনের জন্য গ্রীষ্মকালীন ছুটি ছিল। যদিও পরবর্তীতে তা বাতিল করেছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তার আগের বছর, মানে ২০২২ সালেও গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেওয়ার জন্য বর্ষাকালকেই বেছে নেওয়া হয়।
স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তে ‘সমন্বয়হীনতা’
তীব্র তাপপ্রবাহ ও ঈদের ছুটি মিলিয়ে কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৭টি জেলায় ৩০শে পর্যন্ত এপ্রিল স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে।
খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; ঢাকা বিভাগের ঢাকা ও টাঙ্গাইলসহ সাত জেলা; রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর এবং বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালীর জন্য এই নির্দেশনা প্রযোজ্য।
এছাড়া, শিশুদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এক প্রজ্ঞাপনে বলছে যে আগামী ৩০শে এপ্রিল থেকে দোসরা মে পর্যন্ত সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।
এর আগে, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদ ও নববর্ষ উপলক্ষে ছুটি ছিল ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত। ২১ এপ্রিল থেকে স্কুল-কলেজ খোলার কথা থাকলেও ছুটি আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়।
কারণ, টানা তাপপ্রবাহে দেশের কোনও কোনও স্থানে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত ২৮শে এপ্রিল শেষ পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও তীব্র গরমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়লে তা আর অব্যাহত থাকেনি।
কিন্তু গরমের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে বিভ্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। সেইসাথে, কেউ কেউ এটিকে সমন্বয়হীনতাও বলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান জানান, “প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাঝে সমন্বয়হীনতা আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় প্রাথমিককে ডাকে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে না। ফলে স্কুল বন্ধ নিয়ে এটা সৃষ্টি হচ্ছে।”
বাংলাদেশে শিক্ষা বিষয়ক এরকম আলাদা দু’টো মন্ত্রণালয় থাকার সমালোচনাও করেন তিনি।
গ্রাম ও শহরের স্কুলের পার্থক্য
ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ক্ষতি হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে এই মুহুর্তে স্কুল বন্ধ রাখার বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষক, অভিভাবক ও কর্মকর্তারা।
বিশেষ করে, প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক স্কুলে টিনের ছাউনি থাকে ও গরমে বিদ্যুৎ থাকে না বললেই চলে। তাছাড়া, গ্রামের একেকটি শ্রেণিকক্ষে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী একসাথে বসে। এতজন মানুষ যখন একটি ছোট ক্লাসে একসাথে বসে, তখন এমনিতেই সেখানের তাপমাত্রা বাড়তি থাকে।
“পটুয়াখালীতে তাপমাত্রা অনেক বেশি। আর গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে না। এই অবস্থায় ক্লাস নেওয়াটা শিক্ষকদের জন্য কষ্টকর। বাচ্চাদের জন্য ক্লাস করাটা আরও বেশি কষ্টকর,” বলেন পটুয়াখালীর অভিভাবক সৈয়দ আরিফুর রহমান।
বর্তমান আবহাওয়ায় স্কুল বন্ধ রাখাটা সমীচীন মনে করেন আরেক অভিভাবক পলি ইসলামও, যার দুই সন্তানের একজন ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজ এবং আরেকজন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলে পড়ে।
“এটা তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কারোর হাতে নাই। বাচ্চাদের পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে। তারপরও এই সময়ে স্কুল বন্ধ রাখাটা ঠিক আছে। স্কুল খোলা রাখলে গরমে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়বে,” তিনি বলেন।
তবে সশরীরে গিয়ে ক্লাস করাটা বন্ধ থাকলেও “অনলাইনে ক্লাস নিলে ভালো হতো” বলে মনে করেন মিজ ইসলাম। “কিন্তু স্কুল একবারে বন্ধ থাকায় এখন পড়াশুনা সহ সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে ওরা।”
গৃহশিক্ষকের সহায়তায় তিনি বাচ্চাদের পড়াশুনার ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু গ্রামে সেই সুযোগ কম। সেখানে কোচিং বা গৃহশিক্ষক দিয়ে পড়ানোর রীতি খুব একটা নেই। তার থেকেও বড় কথা যে সেখানকার বেশিরভাগ পরিবারের সেই সামর্থ্যও নেই।
তাই “বাচ্চাদের পড়াশুনা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাপপ্রবাহের কারণে স্কুল বন্ধ রাখার এই সময়টাকে গ্রীষ্মকালীন বন্ধের সাথে সমন্বয় করলে ভালো হয়” বলে মনে করেন মি. রহমান।
“ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আরও কিছুদিন পর গ্রীষ্মকালীন বন্ধ আসবে। কিন্তু তখন আর এত গরম থাকবে না, বৃষ্টি হওয়ায় ঠাণ্ডা এসে যাবে। তাই, এটাকেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি হিসেবে গণ্য করে ঐ সময়ে আর বন্ধ না দিলে ভালো হতো। তাহলে আর বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি হতো না। এটা তো গ্রীষ্মকালীন ছুটি, কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান না যে বন্ধ না দিলে সমস্যার সৃষ্টি হবে”।
কী হতে পারে সম্ভাব্য সমাধান?
এই গরমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা “যুক্তিসঙ্গত না” বলে মনে করেন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান।
তিনিও বলেন যে “আগে বাচ্চাদেরকে বাঁচতে হবে, তারপর লেখাপড়া। গরমের মাত্রা যদি তাদের সহ্যক্ষমতার বাইরে হয়ে যায়, তাহলে ঐ অবস্থায় স্কুলে আসলে তো বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যাবে।”
তাই, যতদিন গরম পড়বে, ততদিন স্কুল বন্ধ রাখাটা সমীচীন মনে করেন তিনি। তার মতে, গরম কমে যাওয়ার পর এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
সেক্ষেত্রে, সূচী কমানো, ক্লাস বাড়ানো বা সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিনের পরিবর্তে একদিন করা যেতে পারে। “তবে করোনার ওই সময়ের মতো ছাড় দেওয়া যাবে না। মানে অটোপ্রমোশন দেওয়া যাবে না।”
তিনি মনে করেন, যে শিক্ষার্থী অটোপ্রমোশন পেয়ে পরের ক্লাসে পা রাখে, তার “লার্নিং গ্যাপ” রয়ে যায়।
“যে সিলেবাস শিখে পরবর্তী ক্লাসে যাওয়ার কথা, সেটি না শিখেই পরবর্তী ক্লাসে যাওয়াতে বিরাট লার্নিং গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই পরবর্তী ক্লাসের পড়া ধরতে পারে না, ফেইল করে,” বলছেন অধ্যাপক রহমান।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরের বছরের গরমের তীব্রতা আগে থেকে বোঝা মুশকিল উল্লেখ করে তিনি গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন।
“এখন আগে থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে বছরের এই সময়টা গ্রীষ্মকালীন ছুটি হবে। তাই, গরমের ছুটিটা সারাদেশে একরকম না রেখে ফ্লেক্সিবল রাখতে হবে এবং তাই তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার উপরে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে, সেরকম নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।”
তিনি পরামর্শ দেন, “এটা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির হাতে ছেড়ে দিতে হবে যে বছরে এতদিন গ্রীষ্মকালীন ছুটি। যখন প্রচণ্ড গরম পড়বে, গরমের ছুটি দিয়ে দিতে হবে এবং পরে ঐ সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে সেটা সমন্বয় করতে হবে। সারাদেশের জন্য একরকম কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা ঠিক হবে না।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বদল আনা প্রয়োজন এবং সরকার ইতোমধ্যেই সে দিকে হাঁটছে, এমনটি বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল)।
তিনি বলেন, “অন্যান্য যে সমস্ত বন্ধ আছে, সেগুলোর সাথে গ্রীষ্মকালীন বন্ধকে আমরা এডজাস্ট করবো।”
তবে তিনি মনে করেন যে আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি দিন স্কুল বন্ধ থাকে। “সেজন্য শিখন ঘাটতি রয়ে যায়। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে।”
“রাজধানীর অভিভাবক, প্রভাবশালী পরিবার, তাদের সন্তান, এদের দিক মাথায় রেখে আমরা মনে করি, স্কুল বন্ধ থাকলে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু তাদের কোচিং আছে, প্রাইভেট টিউশন আছে। তাদের শিখন ঘাটতি হয় না। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে হয়। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে।”
তিনি বলেন যে এই শিখন ঘাটতির কারণে অনেক শিক্ষার্থী মাঝপথে ঝরে পড়ে। তিনি এও বলেন, “এখন আমাদের অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা কার্যক্রম। তাই, স্কুলে আসাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।”
জুলাই মাসে গ্রীষ্মের বন্ধের রেওয়াজ সম্বন্ধে তার বক্তব্য, “গ্রীষ্মের বন্ধ যখন দেয়া হয়, তখন বৃষ্টি পড়ে। এই বছরই অনেক জেলায় একেবারেই বৃষ্টি পড়ছে না। আবার শীতকালীন ছুটি এমন সময়ে দেওয়া হচ্ছে, যখন অত বেশি শীত পড়ে না। আবার শীতকালে যখন অনেক বেশি শীত পড়ছে, তখন স্কুল খোলা।”
গ্রীষ্মকালীন বন্ধের জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা বিকেন্দ্রীকরণ করবো। সে নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। জেলাভিত্তিক সিদ্ধান্ত হবে…জেলায় একটি শিক্ষা কমিটি (থাকবে)। শিক্ষাপঞ্জিটা জেলাভিত্তিক নির্ধারণ করার জন্য ইতোমধ্যেই একটি আলোচনা করছি।”
তিনি জানান, “স্কুলগুলোর সর্বমোট শিক্ষাদিবস যাতে ঠিক রাখা যায়”, এমনভাবে গ্রীষ্মকালীন ছুটির দিন নির্ধারণ করবে ওই জেলাভিত্তিক বা স্থানীয় কমিটি।
তবে কবে থেকে এই ব্যবস্থা চালু হতে পারে, সেটি এখনো জানা যায়নি। সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
শিক্ষাবার্তা ডটকম /এএইচএম/৩০/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.