শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ রোজা, ঈদুল ফিতর ও নববর্ষের লম্বা ছুটি কাটিয়ে স্বাভাবিকভাবেই শ্রেণিকক্ষে বসার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু টানা একমাস ধরে দেশজুড়ে চলা তাপপ্রবাহ সব নিয়ম যেন পাল্টে দিয়েছে। অতি গরমে মাঝে একদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর তাপমাত্রা বিবেচনায় অঞ্চলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) ২৭ জেলায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে পাঠদান। কিন্তু ইতোমধ্যে ৭৬ বছরের রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রার কারণে উচ্চ আদালত নিজে থেকেই সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধের নির্দেশ দেয়। এমন নির্দেশনায় অবশ্য চটেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রী।
প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং খোলা রাখা নিয়ে আদালত এবং মন্ত্রণালয়ের এমন টানাটানিতে দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কেউ কেউ মনে করছেন উচ্চ আদালতের নির্দেশ যেহেতু হয়েছে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। কেউ আবার মন্ত্রণালয় যেহেতু আপিল করার চিন্তা করছে এরপর কি সিদ্ধান্ত আসে তা দেখার অপেক্ষা করছেন। এমন অবস্থায় মঙ্গলবার সকালেও ক্লাসে যাবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়েছে অনেক শিক্ষককে।
সোমবার যে ২৭ জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা জানানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে মুন্সিগঞ্জও। মঙ্গলবার ক্লাস হবে কিনা জানতে এই জেলার একটি প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক সকাল আটটার দিকে ফোন করেন উপাধ্যক্ষকে। অপরপ্রান্ত থেকে এই শিক্ষককে তার প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ জানান, অনেকেই ফোন দিচ্ছে। আমি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি। গিয়ে আপডেট জানাব।
পরে তাকে মন্ত্রণালয়ের বন্ধের প্রজ্ঞাপন পাঠানো হলে কিছুক্ষণ পর জানান আজকে এবং বুধবার (মে দিবস) পাঠদান বন্ধ থাকবে।
শুধু এই শিক্ষকই নন, আরও অনেকেই এমন সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ও বন্ধ রাখা নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকরা সমন্বয়হীনতা দেখছেন বলেও জানিয়েছেন।
এদিকে রোববার পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেও অনেক প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে বন্ধ সংক্রান্ত নোটিশ জারি না করায় অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
পুরান ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর বাবা অভিজিৎ রায় বলেন, শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ বলতে কি বোঝাচ্ছে? পরীক্ষা হবে, ক্লাস হবে না, তাই কি? নাকি বিদ্যালয় বন্ধ কোনটা বোঝাচ্ছে? আমরা তো সবাই কনফিউশানের মধ্যে আছি। বাচ্চারা তো দিশেহারা। এর সমাধান দরকার।
এদিকে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা বন্ধ-খোলা রাখা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করার আগেই শিশু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের বিদ্যালয় ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর লার্নিং সেন্টার বন্ধের কথা জানায় ঘোষণা দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাত অবধি স্কুল থেকে অন্যান্য সময়ের মতো স্কুল বন্ধের নোটিশ না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিভাবকরা।
অভিভাবকদের ফেসবুক গ্রুপে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জুয়েল নামের একজন অভিভাবক পোস্ট করে লিখেছেন, আমাদের কন্যাদের বিদ্যালয়ের টিচাররা কি ঘুমিয়ে গিয়েছে ? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নোটিশ দিয়েছে সেন্ট গ্রেগরী ও নোটিশ দিয়েছে এখনো আমরা নোটিশ পেলাম না। যদি কাল খোলাই রাখে তা তো জানাবে আর বন্ধ রাখলে ও তো জানাবে আমরা কি মাঝ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করব?
বন্ধ-খোলা রাখা নিয়ে টানাটানি যেখান থেকে শুরু
এক মাসের ছুটি শেষে গত রোববার ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসার পাঠদান শুরু হয়। কিন্তু প্রচণ্ড দাবদাহে সবার অবস্থা হাঁসফাঁস। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় শিশু শিক্ষার্থীদের। যে কারণে কেউ কেউ স্কুল বন্ধের কথা বলছেন। কেউ আবার সন্তান পিছিয়ে পড়বে এই চিন্তায় প্রতিষ্ঠান খোলার কথা বলেন।
তারা বলছেন, গরমের কথা বিবেচনায় স্কুল শুরু ও শেষের সময় কিছুটা পরিবর্তন আনা হলেও গরমের তাপে কোনো কিছুই যেন কাজে আসছে না।
অন্যদিকে সব প্রতিষ্ঠানে যেমন শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই, তেমনি ফ্যানও পর্যাপ্ত নেই। ফলে বাচ্চারা স্কুলে গিয়েও ভালো থাকতে পারছে না বলে জানান অভিভাবকরা।
চলমান তাপপ্রবাহে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ায় মত দেন অভিভাবকদের কেউ কেউ।
এদিকে দফায় দফায় হিট অ্যালার্টের মধ্যেই স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ায় শ্রেণিকক্ষে অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে।
সদরঘাটের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী তাসনুভা জান্ন বলেন, ‘আমাদের রুমে এসি আছে। কিন্তু বাসা থেকে আসা যাওয়া করতেই তো দম বের হয়ে যায়। ক্লাস শেষ করে বের হওয়ার পর আরও সমস্যা হয়।’
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর মা মানসুরা আক্তার জানান, যে গরম পড়তেছে এতে রুমের ফ্যানে খুব একটা কাজে আসে না। ছেলেপেলে সবসময় ঘেমে যায়। কখন কে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেই টেনশনে আছি সবাই।
গরমের তীব্রতা বাড়ায় স্কুল খোলার পরদিন সোমবার দেশের ৫ জেলার প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জানানো হয়, ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছাড়ালে স্থানীয় প্রশাসন সেখানকার আলোচনা করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারবে।
এরমধ্যে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে স্কুল-মাদ্রাসা খোলার পর শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়া এবং দেশব্যাপী ১৮ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার (২ মে) পর্যন্ত সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
সোমবার বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।
তবে যেসব স্কুলে এসির ব্যবস্থা আছে, পরীক্ষা চলমান আছে, ও-লেভেল, এ-লেভেল পরীক্ষা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এ আদেশ প্রযোজ্য হবে না বলে আদেশে বলা হয়েছে।
এর কিছুক্ষণ পরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৭ জেলায় শুধু মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না বন্ধ, এ নিয়ে শুরু হয় চরম বিভ্রান্তি।
আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষা সচিব জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ থাকবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার লিখিত নির্দেশনা পাননি বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
আর নির্দেশনা হাতে পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নয়, বরং খোলা রাখতে আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান তিনি।
শুধু তাই নয়, গরমে স্কুলে গেলে অসুস্থ হবে —এমনটা মানতে নারাজ শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যারা অসুস্থ হয়েছেন, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাকি অন্যত্র ছিলেন, তাও দেখার বিষয়।’
উষ্মা জানিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন, স্কুল গরমের জন্য বিপজ্জনক, আর মাঠঘাট নয়?
এদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সবশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সব জেলা এবং রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর জেলা, ঢাকা বিভাগের ঢাকা, টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ এবং বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলায় মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩০/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.