নিজস্ব প্রতিবেদক।।
প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোভনীয় চাকরির বিজ্ঞাপন। পরে বিজ্ঞাপনের খপ্পরে পড়ে যোগাযোগ করলেই মোটা অঙ্কের বেতনের লোভ দিয়ে চাকচিক্য অফিসে নিয়ে ফ্রি-ক্লাস করে দেওয়া হয় মগজ ধোলাই। কৌশলে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এর পর চলে শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন। বাধ্য হয়ে টাকার মায়া ত্যাগ করে অনেকেই পালিয়ে যায়। সম্প্রতি এমন কিছু প্রতিষ্ঠান সাভারের আশুলিয়ায় খুঁটি পুতেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জামগড়া, নবীনগর চন্দ্রা মহাসড়কের পল্লিবিদ্যুৎ শ্রীপুর এলাকায় বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেড, ডিএক্সএন ইন্টারন্যাশনাল ও রূপায়ণ লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড নামে এমন প্রতিষ্ঠান খুলে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত যুবকের কাছ থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সত্যতা মিলেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান এক স্থানে ৩-৬ মাসের বেশি স্থায়ী হতে পারে না। গিরগিটির মতই রং ও স্থান পরিবর্তন করে। ভুক্তভোগীরা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারলেই খোঁজ মেলেনা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের। সম্প্রতি ডিএক্সএন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড জামগড়া এলাকায় প্রতারণার মিশন শেষ করে লিমিটেড নামে পেতে বসেছে প্রতারণার ফাঁদ।
সব প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কৌশল প্রায় একই রকম। প্রথমে জনবহুল এলাকা চিহ্নিত করে ৩-৬ মাসের ভাড়া অগ্রিম প্রদান করে নেওয়া হয় অফিস। কর্পোরেট অফিসের মত ডেকোরেশন করে আকৃষ্ট করা হয় অর্ধশিক্ষিত ও গ্রামের সহজ সরল যুবকদের। প্রথমে চটকদার চাকরির বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এসব বিজ্ঞাপনের ফাঁদে দুই একজন পা দিলেই শুরু হয় প্রতারণার মিশন। এই দুই একজনের মগজ ধোলাই করে প্রশিক্ষণকালীন থাকা-খাওয়া বাবদে নেওয়া হয় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। পরবর্তীতে এই দুই একজনের মাধ্যমে চাকরির কথা বলে তাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনকে ভেড়ানো হয় প্রতারণার ডেরায়। এভাবেই একে অপরের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনকে চাকরির কথা বলে নিজের অজান্তেই নিয়ে আসতে থাকে ডেরায়। এরপর সবার কাছ থেকে প্রশিক্ষণকালীন সময়ের জন্য হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। পরবর্তীতে একটি কক্ষে ৯-১০ জনকে রেখে নাম মাত্র খাবার দিয়ে চলে মানুষিক ও শারীরিক নির্যাতন। এমন নির্যাতন সইতে না পেরে সপ্তাহ শেষ না হতেই পালিয়ে যায় অনেকেই। বাকি ছয় মাসের টাকা চলে যায় প্রতারকদের পকেটে।
বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেডের খপ্পরে পরে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খুইয়েছেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানার শাহাজান সরকারের ছেলে রাকিব সরকার।
তিনি বলেন, পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেডে নিয়ে যায় আমিনুল ইসলাম নামের প্রতারক। পরবর্তীতে চক্রের অপর সদস্য রায়হান ইন্টারভিউ নেয় এবং চাকরি দেওয়ার নামে ৪০ হাজার ৫৫০ কৌশলে নিয়ে নেয়। এভাবেই আমির হোসেন, মাহমুদুল হাসান ও আরমান মিয়াসহ প্রায় ৪০-৫০ জনের কাছে টাকা হাতিয়ে নেয়।
কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম কোম্পানির ভাড়া ম্যাচে রেখে খাওয়ার খরচ বহন করবে বলে কথা দেন। পরবর্তীতে সপ্তাহে দুই দিন মোটিভেশনাল (অনুপ্রেরণা মুলক) ক্লাস করে সদস্য বাড়ানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কিন্তু কোন চাকরি না দিয়ে তালবাহানা করতে থাকে। মেসে ঠিকঠাক খাবার সরবরাহ না করে নানাভাবে মানুষিক নির্যাতন শুরু করে। চাকরির অনুরোধ করলে নানাভাবে ভয়ভীতি ও মারধর শুরু করে। এমতাবস্থায় অনেকে পালিয়ে যায়।
রূপায়ণ লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডে চাকরি নিতে এসেছিলেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার আব্দুস সোবহানের ছেলে কাউছার মিয়া। তিনি বলেন, ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে বিজ্ঞাপনে থাকা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করি। তারা চাকরি দেওয়ার নামে আমিসহ ৩০-৪০ জনের কাছ থেকে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা করে নিয়ে একটি মেসে রাখেন। সেখানে খাবার না দিয়ে আমাদের নানাভাবে কষ্ট দেওয়া শুরু করে। পরবর্তীতে চাকরির জন্য চাপ প্রয়োগ করলে হুমকি ধামকি ও মারধর করে। এমন অবস্থা দেখে আমরা বুঝতে পারি প্রতারিত হয়েছি। পরবর্তীতে আশুলিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করি।
একই ধরনের কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমন ব্যবসা করে আমি র্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। জামিনে মুক্ত হয়ে এখন সৎ উপায়ে ব্যবসা করেছি। আসলে গ্রামের সহজ সরল বেকার ও হতাশাগ্রস্ত যুবকদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হয়। সুকৌশলে মগজ ধোলাই করে টাকা হাতিয়ে নেয় এসব প্রতিষ্ঠান। টাকা নেওয়ার পরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় সপ্তাহ না শেষ হতেই অনেকে পালিয়ে যায়। অনেকে আবার স্বেচ্ছায় চলে যেতে চায়। এসময় তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ফলে কোথাও অভিযোগ না করে তারা আবার গ্রামে চলে যায়।
আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, এমন দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আমরা দ্রুত প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। পাশাপাশি এমন সব প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/২০/০৩/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.