শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ সরকারের জনপ্রশাসনের ৮৬ সচিবের মধ্যে ১০ জন নারী, যা শতকরা হিসাবে ১১ ভাগ। আট বিভাগীয় কমিশনারের মধ্যে এক জন, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ১৭ জনের মধ্যে দুই জন নারী। বর্তমানে সরকারি চাকরির ২৯ শতাংশই নারীদের দখলে। যা সংখ্যায় ৪ লাখ ৯ হাজার ১৩৯ জন। মাত্র এক বছরে ( ২০২১ থেকে ২০২২) নারীদের সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের হার ৩ শতাংশ বেড়েছে। জনপ্রশাসন সচিব মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, স্বাধীনতার ৫২ বছরের মধ্যে বর্তমানে প্রশাসনে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী দায়িত্ব পালন করছেন। এখন একজন কর্মকর্তাকে নারী বা পুরুষ নয়, কর্মকর্তা হিসেবেই গণ্য করা হয়।
তবে আগের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও সংসার রেখে শহরের বাইরে না যাওয়ার মানসিকতা, সংসারের অনেক দায়িত্ব এখনো একা নারীকেই পালন করতে হয় বলে প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছেন অনেক নারী। এমন বাস্তবতার মধ্যেই ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’ প্রতিপাদ্য করে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ১৯৭৩ সালে কোনো নারী সচিব ছিলেন না। ১৯৯৪-৯৫ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন খোদেজা আযম। ২০১২ সালে ছয় জন নারী সচিব দায়িত্ব পালন করেন। গত এক যুগে নারী সচিবের সংখ্যা বেড়েছে ৬৬ শতাংশ।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, আগে সচিব পদে দুই-এক জন ছিলেন, এখন ১০ জন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারীদের সুযোগ দিচ্ছেন বলেই নারীরা দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছেন। তিনি বলেন, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ এখন এসব পদে নারীর উপস্থিতি মেনে নিচ্ছে।
প্রশাসনে নারীর অবস্থান: সরকারের ৮৬ জন সচিবের মধ্যে নারী ১০ জন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবগণের তালিকায় এযাবত্কাল ২৪ জনের স্থান হলেও এক জনও নারী নেই । তবে আট বিভাগীয় প্রশাসকদের এক জন বা ১২ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রশাসকের ১৭ জনের মধ্যে দুই জন বা ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী। ৬৪ জেলা প্রশাসকের মধ্যে সাত জন বা ১০ দশমিক ৯৪ শতাংশ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের ২৬১ জনের মধ্যে ৬২ জন বা ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ৪৫২ জনের মধ্যে ১২৮ জন বা ২৮ দশমিক ৩২ জন এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ৪১৬ জনের মধ্যে ১৪০ জন অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ নারীর দখলে। লক্ষ্মীপুর, ফেনী, মানিকগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঝালকাঠি, গাইবান্ধা ও মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক এবং গোপালগঞ্জ, শেরপুর ও খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপারের দায়িত্বে আছেন নারী।
নেই কোটা কিন্তু বাড়ছে নারী চাকরির সংখ্যা: ২০১৮ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কয়েকটি গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করলেও প্রতি বছরই নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০১৮ সালে ছিল ২৭ শতাংশ। এরপর ২০১৯ সালে ২৮ শতাংশ, ২০২০ সালে ২৮ শতাংশ, ২০২১ সালে ২৬ শতাংশ হলেও ২০২২ সালে আবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ শতাংশে।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহিম আহসান বলেন, শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নারী সচিব করা ইতিবাচক হবে না। তবে যোগ্য নারী সচিব নিয়োগ দেওয়া হলে তারা দেশকে এগিয়ে নিতে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। নারীর একটি আত্মিক শক্তি আছে সে শক্তিবলে ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে কাজ করে। তিনি বলেন, আমি দেখেছি একনেক মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেক পড়াশোনা করে যথাযথ জ্ঞান নিয়ে অংশ নেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরও ঐ বিষয়ের ওপর এত পড়াশোনা থাকে না। তিনি মনে করেন এখন যুগ্মসচিব পর্যায়ে যে নারীরা আছেন তারা এগিয়ে এলেই সচিবালয়ে নারীর শক্ত অবস্থান হবে। তবে নারীকে প্রশাসনে যেতে হলে বিসিএসে ভালো করার মনসিকতা রাখতে হবে।
বিসিএসএও এগিয়েছে নারী: বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের তথ্যমতে, ৩৭তম বিসিএস থেকে ৪২তম বিসিএস পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে সুপারিশপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা। ৩৭তম বিসিএসে নারী ছিলেন ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, ৩৮ তম বিসিএসে ২৬ দশমিক ৯১ শতাংশ, ৩৯তম বিসিএসে ৪৭ শতাংশ, ৪০তম বিসিএসে করোনাকালে কমে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশে, আবার ৪২তম বিসিএস ৫০ দশমিক ৯৮ শতাংশ সুপারিশ প্রাপ্ত হয়ে পুরুষের তুলনায় এগিয়ে যান নারী।
এখনো বাধা পারিবারিক দায়িত্ব: ২৭তম বিসিএসে পাশ করা মুক্তা ধর বর্তমানে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপারের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, আর দশটা মায়ের মতো আমি আমার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারি না। তার পরও যখন ভাবি নিজের সন্তাদের এই দায়িত্ব পালন না করে আমরা হাজার সন্তাদের বাবা-মাকে নিরাপত্তা দিচ্ছি, অনেক কিশোর-কিশোরীকে বিপথ থেকে রক্ষা করছি—তখন নিজের মধ্যে কাজের অনুপ্রেরণা পাই। ৩১তম বিসিএস সম্পন্ন করা জেসমিন সুলতানা এখন ব্রা??হ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। তিনি জানান, যখন বাচ্চা ব্রেস্টফিডিং করত তখন তার পাশে না থাকতে পারার জন্য নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করত। তারপর ভাবতাম আমি যদি ভালো কাজ করতে পারি তবে আমার সন্তানের জন্যই সবচেয়ে বেশি গর্বের হবে।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন সচিব মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নারী কাজ পারে এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। দায়িত্ব দেওয়ার সময় এখন কর্মকর্তা হিসেবে নারীদের মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু পরিবার রেখে অনেক নারীই কাজের সুযোগ নিতে চান না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন সচিব পর্যায়ে ১১ শতাংশ এবং সরকারি পর্যায়ে ২৯ শতাংশ নারী আমাদের অনেক বড় অর্জন। তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। তিনি বলেন, আমরা দেখছি নারীর অগ্রযাত্রায় তিনটি চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান—সম্পদ, সময় এবং কাজ। এসব নারীকে প্রতিনিয়তই নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করতে হচ্ছে। নারীরা এখনো একজন পুরুষের তুলনায় সাত গুণ বেশি সংসারের কাজ বা সেবা কাজে যুক্ত—এজন্য তাদের অনেক সময় ব্যয় হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। এছাড়া নারী আয় করলেও আয়ের ওপর তার অধিকার থাকে না। সম্পদে তার অধিকার কম। ফলে নারীর প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তনের গতি খুবই ধীর। ইত্তেফাক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/০৩/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.