রাগিব হাসানঃ আমার ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অফিসের সিনিয়র একজন ডিরেক্টর আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসেছিলেন। কম্পিউটার সায়েন্সে প্রায় ৭০০ জন বিদেশি ছাত্রছাত্রী আছে, যার অধিকাংশই ভারতীয়। ইন্টারনন্যাশনাল স্টুডেন্টদের পড়াতে গিয়ে যাতে করে আমরা কালচারাল পার্থক্যগুলো খেয়াল করে তাদের যথাযথ সাহায্য করতে পারি, তার জন্য এই প্রেজেন্টেশন। আসলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির কালচারের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের পড়াশোনার রীতির তফাৎগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং এবং শিক্ষক হিসাবে এগুলো জেনে বুঝে সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করাটা আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রেজেন্টেশন দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম একই ব্যাপার বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে খাটে। অথচ শিক্ষকেরা একটু সচেতন হলে এই সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু কী সেই পার্থক্য? আসুন দেখা যাক। [১] প্রশ্ন না করার সংস্কৃতি খেয়াল করে দেখুন, এমন হয়েছে কি না। ক্লাসে শিক্ষক কিছু একটা পড়াচ্ছেন, আপনি হয়তো কিছু একটা বুঝতে পারেননি, কিন্তু সেটা কি প্রশ্ন করেছেন? না করেননি।
কারণ [ক] প্রশ্ন করলে বন্ধুরা আঁতেল বলে হাসাহাসি করবে, এবং [খ] শিক্ষক রেগে যেতে পারেন ‘এটাও জানো না?’। ছোটবেলা থেকে আসলে আমাদের এটা মাথায় ঢোকানো হয়েছে যে প্রশ্ন করা খারাপ। শিক্ষকেরা যা বলেছেন সেটা না বুঝলে সমস্যাটা ছাত্রেরই। কাজেই প্রশ্ন করাটা বেয়াদবি। এই প্রশ্ন না করার ব্যাপারটা মজ্জাগত হয়ে যায় এক সময়ে। আমি খেয়াল করে দেখেছি, এশিয়ান শিক্ষার্থীরা ইউনিভার্সিটির ক্লাসে তেমন প্রশ্ন করে না। অথচ আমেরিকার স্থানীয় শিক্ষার্থীরা প্রতিটি ক্লাসেই অনেক প্রশ্ন করে কারণ ছোটবেলা থেকে তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেয়া হয়। এই ব্যাপারটা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার জগতকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ প্রশ্ন করার মাধ্যমেই শেখা সম্ভব। তাই শিক্ষকদের উচিৎ প্রশ্ন করাকে লেকচারে অংশ হিসাবে শুরু করা আর শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা।
গুরু কালচার ভারতীয় উপমহাদেশে, ভারত ও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখেন। ব্যতিক্রম আছে বটে। কিন্তু কমন ট্রেন্ড হলো যে, শিক্ষকদের সবকিছু আলাদা থাকবে। একটা বড় উদাহরণ হলো শিক্ষকদের জন্য আলাদা লিফট, বাথরুম এসব। এতে করে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের একটা ভয়ের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। গুরু-শিক্ষক, গুরুকে চরম সম্মান করা, এগুলো তো ভারত বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ, তাই না? সেই গল্প তো আমরা পড়ে বড় হয়েছি, শিক্ষকের পা ধুয়ে দিচ্ছে ছাত্র। কিন্তু ভয়, ধমক, এসবের মাধ্যমে যতটা ভালো শেখা যায়, তার চাইতে অনেক ভালো করে শেখা যায় যত্ন, মায়া, আর স্নেহের মাধ্যমে। শিক্ষকদের সম্মান অবশ্যই করতে হবে কিন্তু সেই সম্মান করতে গিয়ে তাদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করলে শিক্ষার্থীরা শিখবে কেমন করে?
বাংলাদেশে আমার শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষককে পেয়েছি, যারা এই দূরত্বটা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার স্কুলের সেসব শিক্ষকের কথাই আপনার হয়তো মনে আছে, যারা বহু দূর উঁচু আসনে থাকা গুরু নয়, বরং খুব কাছের মানুষ হিসাবে স্নেহের সাথে আপনার মনে স্থান করে নিতে পেরেছেন। আমাদের দরকার এই রকমের বন্ধুসুলভ শিক্ষকদের প্রণোদনা দেয়া, যাতে করে আস্তে আস্তে এই গুরু-কালচার থেকে আমরা বেরুতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভালো শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের থেকে এত দূরে গুরুর সুউচ্চ আসনে থাকতে চান না। সব শিক্ষকেরা কি এসব ভালো শিক্ষকদের উদাহরণকে অনুসরণ করা শুরু করবেন?
শিক্ষা কার দায়িত্ব? প্রেজেন্টেশনের একটা স্লাইড ছিলো এমন যে, সাধারণত দক্ষিণ এশিয়াতে শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব। মানে শিক্ষকেরা বিষয়টি উপস্থাপন করেন ক্লাসে। বোঝার দায়িত্ব ছাত্রের। না বুঝলে সেটা ছাত্রের সমস্যা। শিক্ষকের নয়। অনেক শিক্ষক অবশ্যই এমন নয়। তারা অনেক চেষ্টা করেন বটে। কিন্তু মোটা দাগে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ক্লাসের দুর্বলতম শিক্ষার্থীদের জন্য লেকচার তৈরি হয় না, বরং লেকচারটি তৈরি হয় ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থীদের জন্য। ফলে ক্লাসে শেখার বদলে দুর্বল শিক্ষার্থীরা অন্যের ক্লাসনোট কপি করে কিংবা বছরের পর বছর ধরে ফটোকপি হতে থাকা নোট নিতে ফটোস্ট্যাটের দোকানে দৌড়ায়। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই দায়িত্ব পড়াশোনাকে বোঝার জন্য অনেক চেষ্টা করা। কিন্তু এখানে শিক্ষকেরও দায়িত্ব আছে, ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চের জন্য না পড়িয়ে লাস্ট বেঞ্চের দিকেও মনোযোগ দেয়া। যারা এই কাজটা করতে পারেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এমন কিছু শিক্ষকের ক্লাস করার। আমাদের দরকার শিক্ষাক্ষেত্রের কালচারটাকেই এমন করার, যাতে করে লাস্ট বেঞ্চারদের অবহেলা না করে বরং তাদের কথা মাথায় রেখেই ক্লাসরুমে লেকচার সাজানো হয়।
শিক্ষকদের জন্য কাঠামোগত সুবিধা দেয়া এবারে উল্টাদিকে আসি। ভালো শিক্ষকদের উৎসাহ দেয়া অথবা ছাত্রবান্ধব নানা কাজের জন্য কী করা যায়? আসলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যস্ততা কম নয়। ছাত্রদের সাথে কথা বলার জন্য অফিস আওয়ারের ব্যাপারটা কাঠামোগতভাবে আনা গেলে তাদের জন্যও সুবিধা হয়। যখন তখন যে আসবে তাকেই সময় দিতে হবে এই ব্যাপারটা বাস্তব সম্মত না। তার বদলে যদি প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট সময়ে ১ বা ২ ঘণ্টা ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ রাখার নিয়ম করা যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তাহলে এই ব্যাপারটা অনেক সহজ হয় ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্যই। আর তা ছাড়া ইউনিভার্সিটি লেভেলে শিক্ষকদের সহায়তার জন্য টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট এর পদ্ধতিটি চালু করা সম্ভব। এতে করে অনেক শিক্ষার্থীর যেমন কর্মসংস্থান হবে, তেমন করে শিক্ষকদের উপরেও অনেক কিছুর চাপ কমবে। শিক্ষকেরাও গতবাধা সব কাজের চাপ থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষকতায় তাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে পারবেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাক সব বাধা এড়িয়ে। সব শিক্ষার্থীর জন্য তৈরী হোক একটি বন্ধুসুলভ শিক্ষাব্যবস্থা।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/০২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.