ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুর উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের হাজিরা নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক মেশিন কেনা নিয়ে বড় ধরনের ঘাপলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা শিক্ষা অফিস ৩১৭টি বিদ্যালয়ের (ঈশ্বরগঞ্জে ১৪০টি ও গৌরীপুরে ১৭৭টি) প্রধান শিক্ষকদের নির্ধারিত দোকানের অগ্রিম ভাউচারে ৩০ হাজার টাকার অঙ্ক লিখে জমা দিতে বলে। বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ স্লিপের টাকা থেকে এই মেশিন কেনা হবে। এরই মধ্যে প্রধান শিক্ষকরা অগ্রিম ভাউচার সংগ্রহ করে শিক্ষা অফিসে জমা দিয়েছেন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষকদের ব্যাংকের যৌথ অ্যাকাউন্টে স্লিপের টাকা পৌঁছেও গেছে। এখন টাকা উত্তোলন করবেন নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান।
সরকারি জিনিস দরপত্র বা নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে কেনার কথা। সেখানে নির্ধারিত হবে কোন ব্র্যান্ডের পণ্য কত টাকা দিয়ে কেনা হবে। এর আগেই ৩০ হাজার টাকার ভাউচার জমা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, মেশিন কে কিনবে, কত টাকা দিয়ে কিনবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ঘটনাটি নিয়ে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ চলছে শিক্ষকদের মাঝে। তবে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
কয়েকজন প্রধান শিক্ষক জানান, শিক্ষার্থী অনুযায়ী স্লিপের টাকা বরাদ্দ হয়ে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ থাকে। এ টাকা দিয়ে বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়ে থাকে। এবার সেই টাকা থেকেই বায়োমেট্রিক মেশিন কেনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয় এবং চিঠি আসে। কিন্তু উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্য এক নির্দেশে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কথা বলে নির্ধারিত ভাউচারে ৩০ হাজার টাকা লিখে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশে প্রথম দিকে প্রতিবাদের ঝড় বইলেও ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে পরে এই অগ্রিম ভাউচার জমা দিয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা।
গণমাধ্যমের কাছে আসা একটি ‘চালান/ক্যাশ মেমো’ থেকে জানা যায়, রাজধানীর মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ‘সপ্তক আইটি লিমিটেড’ নামে একটি দোকানের ভাউচার ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুর উপজেলার ৩১৭টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। এ ভাউচারে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয় ও বাস্তবায়ন এবং টাকার পরিমাণের ঘরে ৩০ হাজার টাকা লিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষর দিয়েছেন। আর এর সঙ্গে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে মর্মে একটি রেজুলেশনও জমা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্যরা জানান, প্রধান শিক্ষক তাঁদের কাছে বরাবরের মতো খাতা নিয়ে গেছেন আর বিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে চোখ বুঝে সই করেছেন কমিটির সদস্যরা। এখন বিভিন্ন কথাবার্তা শুনে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রাখবেন বলে জানিয়েছেন সদস্যরা।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনার কলি নাজনীন এবং গৌরীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এখানে তাঁদের কিছু করার নেই। জেলা অফিস থেকে যে ধরনের সিদ্ধান্ত এসেছে তা যথাযথ পালন করা হচ্ছে মাত্র।
তবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ভাউচারের ঘটনাটি আমি জানি না। বায়োমেট্রিক যন্ত্রটি কিনবেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষক। তাঁরা যেকোনো জায়গা থেকে কিনতে পারেন। এতে আমার কোনো হস্তক্ষেপ নেই।’
সপ্তক আইটি লিমিটেড নামের দোকানের ক্যাশ ভাউচারে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে কল করলে ফোনটি ধরেন সাইফুল ইসলাম নামে একজন। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির পরিচয় দিয়ে কথা বলা হলে সাইফুল ইসলাম নিজেকে সপ্তক আইটির এমডি পরিচয় দিয়ে গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জে কাজটি পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘কমিশনসহ সব কিছু মিলে খরচ হতে পারে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।’ আমার লোকজন আছে, তাঁদের ম্যানেজ করতে হবে। এ জন্য আরেকটু কমে হবে কিনা’—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হবে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলেন।’
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বায়োমেট্রিকের যন্ত্রটি ব্র্যান্ডবিহীন কিনলে প্রতিটির মূল্য পড়বে ছয হাজার থেকে সাত হাজার টাকা। আর ব্র্যান্ডের হলে সব কিছু মিলে খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। এ অবস্থায় ওই দুই উপজেলায় বায়োমেট্রিক যন্ত্র সরবরাহ হলে চক্রটি হাতিয়ে নিতে পারবে অর্ধকোটি টাকা।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হাসান সুমন বলেন, নামকাওয়াস্তে মেশিন দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা হতে দেওয়া হবে না।
গৌরীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, ‘এসব বিষয় আমাকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানাননি। এখন খোঁজখবর নিয়ে এই টাকা লুটের পাঁয়তারা বন্ধ করা হবে।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক উপস্থিতি কম থাকায় পাঠদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে দিনের পর দিন। এ অবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন বসানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.