শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন সাজ্জাদ হোসেন। সপ্তাহখানেক আগে রাজধানীর আজিমপুর এলাকার একটি ওষুধের দোকান থেকে মন্ট্রিল ১০ মিলিগ্রাম ওষুধ কেনেন। সেবনের এক দিন পর লক্ষ্য করেন, ওই ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তিন দিন আগে। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি।
কথা হলে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খাওয়ার পর মনের মধ্যে ভীতি কাজ করতে শুরু করে। এতে শরীরে অন্য কোনো জটিলতা কিংবা নতুন কোনো সমস্যা তৈরি হয় কি না তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। এ কথাও ভাবি, বিষয়টি ডাক্তারকে জানাব কি না, জানালে ডাক্তার যদি জিজ্ঞেস করেন, কেন খেয়েছেন, তখন কি জবাব দেব! এমন অসংখ্য চিন্তা ভিড় করে মনে।’
সাজ্জাদের মতো অনেক রোগী মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবন করে মানসিক দুশ্চিন্তায় পড়েন। রাজধানীসহ সারা দেশের অসংখ্য ওষুধের দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। যদিও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সংরক্ষণ ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাও রয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করলে ওষুধের দোকানের নিবন্ধন বাতিলসহ কড়া নির্দেশনা রয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরেরও। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধে মাঝেমধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশের ওষুধের দোকানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কিংবা জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জরিমানাসহ বিভিন্ন দণ্ডও দেন। কিন্তু তারপরও ওষুধের দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেক রোগী না জেনে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিনে সেবন করে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। কারণ এতে রোগীর পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছেন। আরোগ্য লাভের পরিবর্তে নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবন করলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওষুধের দোকানগুলোতে পুরো পাতা ওষুধ বিক্রি না করে পাতা কেটে তিনটা বা চারটা করে বিক্রি করায় অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কোথায় লেখা থাকে সেটাও অনেকে জানেন না। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ওষুধ সেবনে কতটা ক্ষতি হতে পারে সে সম্পর্কেও অনেকের ধারণা নেই। এসব কারণে যারা জানতে পারেন যে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবন করেছেন তাদের মধ্যে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের ভীতি ও বিভ্রান্তি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কল সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে তাদের কাছে মেয়াদোত্তীর্ণ, বাড়তি দাম ও নিম্নমানের ওষুধ সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে ৫১৩টি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ওষুধ ও স্যালাইন সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে ২৪৫টি। অক্টোবরে ওষুধ সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে ১৬৬টি এবং নভেম্বরে এসেছে ১০৫টি। এ ছাড়া এই তিন মাসে ওষুধ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় জানতে চেয়ে ফোন করেছেন ১৫৩ জন। এসব অভিযোগের ৬০-৭০ শতাংশ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকি অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি এখনও প্রক্রিয়াধীন।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রোগীর স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর, এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক একে লুৎফুল কবীর বলেন, ‘সাধারণত রোগীরা ওষুধ সেবন করেন রোগ সারানোর জন্য। সেখানে যদি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবন করে রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন তা হলে কোনো মানে দাঁড়াল না। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রোগ সারাতে অকার্যকর এবং বিষাক্ত। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ওষুধের দোকানগুলো যাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি না করে সে জন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। লাইসেন্স বাজেয়াপ্তের নির্দেশনাও রয়েছে। তারপরও অনেক ওষুধের দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে যা মোটেও ঠিক নয়।’
তিনি জানান, ‘একটি ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে যে কেমিক্যাল কিংবা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, তার নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলি ও মেয়াদ থাকে। এ কারণেই ওষুধ উৎপাদনের তারিখ থেকে কতদিন ব্যবহার করা যাবে তার তারিখও দেওয়া হয়। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার করা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মুনীর উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কোনো রোগী যদি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে ফেলে তাতে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। সাধারণত সব ওষুধের কার্যক্ষমতা আলো, তাপ, আর্দ্রতা এবং সংরক্ষণ পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। যদি সঠিক নীতিমালা মেনে ওষুধ তৈরি করা হয় এবং নির্দেশিত পরিবেশে রাখা হয় তবে দীর্ঘদিন ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। লিকুইড বা ইনজেকটেভল ফর্মে যদি ওষুধ উৎপাদন করা হয় তা হলে হয়তো কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে। ভিটামিন জাতীয় ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও মানুষের শরীরে খুব বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। হয়তো কার্যকারিতা কম হবে। তবে অ্যান্টিবায়োটিক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে খাওয়া উচিত নয়। কারণ এসব ওষুধ সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। মেয়াদোত্তীর্ণ জীবন রক্ষাকারী এসব ওষুধ খেলে অন্য সংকট তৈরি হতে পারে, রোগীর জীবনের জন্য অনেক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘ওষুধের মেয়াদ দেওয়াই হয় যেন নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে বাজার থেকে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের কাক্সিক্ষত কার্যকারিতা থাকে না। রোগীর কোনো ধরনের উপকারে আসে না। এতে অনেক রোগের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তবে কতটা ক্ষতি করবে এককভাবে তা বলা কঠিন।’ সময়ের আলো
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.