আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ খোকসা সরকারি কলেজ ফান্ড থেকে মাত্র চার মাসে ২৬ লাখ টাকা তছরুপ করেছেন কলেজটির অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোঃ নাজমুল হুদা রাসেল। তিনি তার অপকর্মের সঙ্গী হিসেবে তিন জনের নাম উল্লেখ করেছেন। এই তিন জন হলেন কলেজটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত) মুহঃ আনিছ-উজ-জামান, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (চলতি দায়িত্বে) ও সহকারী অধ্যাপক মোঃ বেলাল উদ্দিন, অর্থনৈতিক কমিটির সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনিছুর রহমান।
শুধু অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোঃ নাজমুল হুদা রাসেল কর্তৃক উল্লেখ করা নামেই নয় এই তিন জনের নাম উঠে এসেছে সম্প্রতি কলেজটির অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির করা অডিটেও। অডিটে অফিস সহকারী নাজমুল হুদা রাসেল এবং তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত/নিরীক্ষার মাধ্যমে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণসহ দায়ী ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আইনগত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে অডিট কমিটির করা প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসক ছাড়া এখনও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রশাসনে পাঠানো হয়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে তারা এ সংক্রান্ত কোন অডিট রিপোর্ট হাতে পাননি।
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ইং তারিখে ‘সাবেক অধ্যক্ষের যোগসাজশে ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ অফিস সহকারীর‘ শিরোনামে এবং গত ১২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে ‘এখনও বহাল তবিয়তে খোকসা সরকারি কলেজের সেই অফিস সহকারি‘ শিরোনামে দুইটি সংবাদ প্রকাশিত হয় শিক্ষাবার্তা’য়। প্রকাশিত সংবাদের পরে নড়েচড়ে বসে কলেজ প্রশাসন। আটকে থাকা অডিট দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
তবে শিক্ষাবার্তায় সংবাদ প্রকাশ এবং অভিন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির অডিট আপত্তি থাকলেও যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তাকে এখনও হিসাব শাখায় বহাল তবিয়তে রেখেছেন কলেজ প্রশাসন। শিক্ষকরা বলছেন, নাজমুল হুদা রাসেল মূলত অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী। তাহলে তার বিরুদ্ধে মাত্র চার মাসে ২৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলো এবং তা অডিটে ধরা পরলেও তিনি তার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাব সহকারী পদে এখনও কীভাবে এবং কাদের ছত্রছায়ায় বহাল তবীয়তে আছে তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
অডিট রিপোর্টে অনুযায়ী, অত্র কলেজের ছাত্র/ছাত্রীর নিকট থেকে গৃহীত যাবতীয় ফিসাদির বেতন বহি:, ভর্তি, নিবন্ধন, পরীক্ষা, সেশনচার্জ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফিস, দৈনিক অনলাইন ব্যাংক বিবরণীর ফিস আদায়ের রেজিস্টার বহিঃ, সকল ক্যাশ বহি:, ব্যাংক বিবরণী, ব্যয় ভাউচার, ব্যয় অনুমোদন নোট শীট, ব্যবহৃত/অব্যবহৃত সকল চেকবই সমূহ, জনতা ব্যাংক লিমিটেড খোকসা শাখার হিসাব সমূহের অর্থ জমাদানের রশিদ অথবা আদেশনামা পত্র, অনার্স সহ বিভিন্ন শ্রেণীতে ভর্তির নিশ্চয়নপত্র, বিভিন্ন পরীক্ষার রোলশীট, ব্যয় নীতিমালার সরকারি আদেশনামা ইত্যাদি সকল তথ্য উপাত্তের কোন কিছু দাখিল করেননি এবং কোনরূপ সহযোগিতা না করে একটা মনগড়া আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেন অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোঃ নাজমুল হুদা রাসেল।
অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোঃ নাজমুল হুদা রাসেল কর্তৃক অডিট কমিটিকে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অটিড আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিধি বহির্ভূতভাবে কলেজ জাতীয়করন করা বাবদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন ও সকল শিক্ষকের অনুমতি সাপেক্ষে খরচ দেখানো হয়েছে টাকার পরিমান ২২ হাজার টাকা। অনুমোদন ও বৈধ ব্যয় ভাউচার ছাড়া সাবেক অধ্যক্ষ মুহা: আনিস উজ-জামান দুই দফায় দায় পরিশোধ বাবদ টাকা উত্তোলন দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা। অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অর্থ কমিটির সদস্য মো: আনিসুর রহমানের নামে অনুমোদন ও বৈধ ব্যয় ভাউচার বিহীন বিবিধ খাত, ক্রয়, আলমারী ও কেবিনেট মেরামত বাবদ টাকা উত্তোলন দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। কোন রকম ব্যয় ভাউচার ছাড়া অনুমোদন বিহিন সম্পূর্ণ অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সাবেক অধ্যক্ষ মুহা: আনিস-উজ-জামান এর নামে অগ্রিম টাকা উত্তোলন দেখানো হয়েছে ৩ লাখ টাকা। সংস্কার কাজের সরকারি নীতি/বিধান অনুসরণ না করে ব্যয় ভাউচার ছাড়া কলেজ উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে সাবেক অধ্যক্ষ মুহা: আনিস-উজ-জামান ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুহা: আনিসুর রহমানের নামে টাকা উত্তোলন দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৭০৫ টাকা। সাবেক অধ্যক্ষ মুহা: আনিস-উজ-জামান ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মুহা: আনিসুর রহমানের ঢাকা যাতায়াত বাবদ কোন বিল ভাউচার ছাড়া খরচ দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। “ভুলক্রমে” ফাইল নোট ছাড়া ব্যক্তিগত একাউন্ট/তহবিল থেকে ১২টি সোনালী সেবা করা হয়েছে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫৮ টাকা এবং পাওয়া ৮২ হাজার টাকা। ব্যয় ভাউচারের মাধ্যমে যে খরচ দেখানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার ব্যয় ভাউচার চাহিদা সত্ত্বেও অডিট কমিটির সামনে উপস্থাপন করা হয় নাই।
উল্লেখিত হিসাবে দেখা যায় যে, উক্ত ব্যয়ের খাতের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন না করে, খোকসা সরকারী কলেজের টাকা নিজ তহবিলে রেখে, ক্রয়/ উন্নয়ন/খরচ এর সরকারি নীতিমালা/বিধিবিধান অনুসরণ না করে শুধুমাত্র তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিনের নীরব সম্মতিতে এবং সাবেক অধ্যক্ষ মুহা: আনিস-উজ-জামান ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অর্থ কমিটির সদস্য মো: আনিসুর রহমানের সহযোগিতায় উক্ত প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মো: নাজমুল হুদা রাসেল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি করেছেন সর্বমোট = ২৬,৪৮,৬৬৩/= (ছাব্বিশ লাখ আটচল্লিশ হাজার ছয়শত তেষট্টি) টাকা।
অডিট রিপোর্টে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, খোকসা সরকারি কলেজ, খোকসা, কুষ্টিয়াকে জাতীয়করণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয় ০৮ আগষ্ট ২০১৮ খ্রিঃ। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন মহোদয়ের সময়কালে মাত্র প্রায় চার মাসের আয়-ব্যয়ের অডিট করানো হল। অথচ এ সামান্য সময়ের মধ্যে হিসাবের যে গড়মিল, অনিয়ম পাওয়া গেছে তা অবিশ্বাস্য। কলেজের পুরা সময়কালের নিরীক্ষার ফলাফল হয়তো আরো ভয়াবহ হবে।
অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির তিন সদস্যরা হলেন, আহ্বায়ক ছিলেন সহকারী অধ্যাপক (সমাজকর্ম বিভাগ) মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, সদস্য ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মোঃ শফিকুল ইসলাম ও সদস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আ.শ.ম শরাফাত আলী।
অডিট আপত্তিতে কলেজটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত) মুহঃ আনিছ-উজ-জামান, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (চলতি দায়িত্বে) ও সহকারী অধ্যাপক মোঃ বেলাল উদ্দিন, অর্থনৈতিক কমিটির সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনিছুর রহমান এর নাম উঠে আসলেও অডিট প্রতিবেদনে তাদের কোন মতামত এবং তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (চলতি দায়িত্বে) ও সহকারী অধ্যাপক মোঃ বেলাল উদ্দিন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি যার বিরুদ্ধে চিঠি ইস্যু করলাম সঠিক হিসাব নিকাশ করতে। আর আমাকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া হলো। এর সাথে আমি জড়িত নই। অডিট কমিটির সাথে আমার ভালো সম্পর্ক নেই তাই এরকমটা হয়েছে।
আর্থিক অনিয়ম অস্বীকার করে কলেজটির অর্থ কমিটির সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনিছুর রহমান শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি কোন টাকা পয়সার অনিয়ম করিনি। অডিট কমিটি আমাকে ফাঁসিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সহকারী অধ্যাপক (সমাজকর্ম বিভাগ) মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। তবে তার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন বিশ্বাস শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আসলে একটি সরকারি কলেজের আর্থিক অনিয়মের বিষয় নিয়ে আমি তো সুপারিশ করতে পারিনা। যে সময়কার অডিট সে সময় আপনি কলেজটির আয়ন-ব্যয়নের দায়িত্বে ছিলেন এবং আপনার এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে আর্থিক কর্ম সম্পাদন করা হত সেই জায়গা থেকে কোন সুপারিশ কিংবা ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কি’না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যদি অধ্যক্ষ মহোদয় আমাকে কোন সুপারিশ করতে বলেন আমি অবশ্যই করব।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ মিজানুর রহমান শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করছে।
এ বিষয়ে কলেজটির সদ্য যোগদান করা শিক্ষা ক্যাডার অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহা. আব্দুল লতিফ শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমার ১৪ তারিখে প্রশিক্ষণ শেষ হবো। যোগদানের পরের দিন থেকেই ঢাকায় প্রশিক্ষণে থাকায় সার্বিক বিষয়ে কোন কিছু করতে পারছি না। তবে সব বিষয়ে খোঁজ খবর রাখছি। আশাকরি দায়িত্ব পুরোপুরি বুঝে নিলে বিষয়গুলো নিয়ে ভালোভাবে দেখভাল করতে পারব। তবে কাউকে ছাড় দেবো না।
যার বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ তাকেই সেই হিসাবের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে যথাযথ ব্যবস্থা নিব।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া দুদক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নীল কমল পাল শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, চার মাসে যদি ২৬ লাখ টাকার অডিট আপত্তি থাকে তাহলে সরকারি করণের পর গত প্রায় পাঁচ বছরে আর্থিক অনিয়ম আসলে অনুমেয়। আপনাদের আগের করা সংবাদ গুলো আমাকে পাঠান আমি যাচাই বাছাই কমিটির মাধ্যমে এটা দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিব।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক শেখ হারুনর রশিদ শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি জেনেছি। অডিট রিপোর্টার টি এখনও পায়নি। যতদূর জানি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তা’য়: আসছে পরবর্তী প্রতিবেদন খোকসা সরকারি কলেজের দৈনিক মুজুরিভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.