এইমাত্র পাওয়া

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, হ-য-ব-র-ল

ঢাকাঃ নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে গ্রেডিং পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে-ত্রিভুজ, বৃত্ত আর চতুর্ভুজের মতো চিহ্ন। ত্রিভুজ শিক্ষার্থীর সবোর্চ্চ পারদর্শিতার চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবার রুপ নিয়েছে ত্রিভুজ পাওয়ার লড়াইয়ে।

শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের বিষয়টি হ-য-ব-র-ল হওয়ায় কাটছে না অসম প্রতিযোগিতা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, মূল্যায়নের জন্য জ্যামিতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হলেও ট্রান্সক্রিপ্টে উল্লেখ থাকবে না এসব চিহ্ন।

চলতি বছরে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। প্রচলিত পরীক্ষার পরিবর্তে বছর জুড়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন শেষে নভেম্বরে চলছে সামষ্টিক মূল্যায়ন। তবে মূল্যায়নে নেই নম্বর বা প্রচলিত গ্রেডিং। শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা মূল্যায়নে শিক্ষকরা ব্যবহার করছেন ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজের মতো জ্যামিতিক চিহ্ন।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর থেকে পাঠানো মূল্যায়ন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীর সবোর্চ্চ পারদর্শিতা বোঝাতে ব্যবহার করতে হবে ত্রিভুজ। পারদর্শিতার সর্বনিম্ন সূচক-চতুর্ভুজ। আর কোনো শিক্ষার্থী তিনটি বিষয়ে চতুর্ভুজ পেলে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার জন্য বিবেচিত হবে না।

অভিভাবকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ফলাফলভিত্তিক অসম প্রতিযোগিতা থাকবে না বলা হলেও, গ্রেডিং পদ্ধতির জিপিএ-৫ পাওয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবার রুপ নিয়েছে ত্রিভুজ পাওয়ার লড়াইয়ে।

শিক্ষা গবেষকরাও বলছেন, গ্রেডিং পদ্ধতি নাম বদলে জ্যামিতিক চিহ্নে রুপান্তরিত হয়েছে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানসম্মত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে মূল ফোকাসটি যেটি ছিল, সেখানে আউটপুটে গিয়ে থাকতে পারিনি, সরে গেছে। সেটি হলো দলবদ্ধ মূল্যায়ন বা আমাদের এখানে যেভাবে সারাক্ষণ মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেই মূল্যায়ন, দলগত মূল্যায়ন, আলাদা আলাদা মান নির্ধারণ, শিক্ষাথী কেন্দ্রীক যে মূল্যায়ন সেটি কিন্তু অবহেলিত হচ্ছে। যদি আমি বলি, এ- বি-সি আর ত্রিভুজ, বৃত্ত আর চতুর্ভুজ পার্থক্যটা কোথায়? এই বিষয়টি পরিস্কার করার প্রয়োজন ছিল। এটার সঙ্গে যে শিক্ষার্থীদের মার্কিং করার বিষয়টি সেটা তো আছে, আছে না। সেটাও তো অভিভাবকদের কাছে পরিস্কার না। শিক্ষার্থীরা কত নাম্বার পাচ্ছে সেটা কি বলা হচ্ছে, হচ্ছে না।

তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, শিক্ষার্থী মূল্যায়নের রেকর্ড রাখার জন্য জ্যামিতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হলেও ট্রান্সক্রিপ্টে উল্লেখ থাকবে না এসব চিহ্ন।

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে বলে মনে করে কর্তৃপক্ষ।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, কোন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের বিকশিত হওয়ার সুযোগটা বেশি; সেটাও কিন্তু ট্রান্সক্রিপ্টের মধ্যে দিয়ে বের হয়ে আসবে। ফলে যে প্রতিযোগিতার আশঙ্কা আমরা করছি, সেই প্রতিযোগিতাটা এখানে হবে না।

নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান প্রক্রিয়ায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগের মতো কেবল শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মধ্যে প্রক্রিয়াটি সীমিত নয়। এ শিক্ষা পদ্ধতি বেশির ভাগ শিক্ষকের কাছে নতুন হওয়ায় তাদের কাছেও বিষয়টি অনুধাবন করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল মনে হচ্ছে। এ শিক্ষাক্রম বোঝা ও পাঠদানের জন্য শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র পাঁচ দিন। অনেকে এ প্রশিক্ষণও পাননি বলে জানা গেছে।

এদিকে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সামষ্টিক মূল্যায়নের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। একটি সেশন অনুষ্ঠিত হবে সর্বোচ্চ ৯০ মিনিট। এর আগে বুধবার নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নভিত্তিক অ্যাপ ‘নৈপুণ্য’ উদ্বোধন করা হয়। এই অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। সামষ্টিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কেমন এবং কীভাবে করতে হবে, তার টুলস (নির্দেশিকা) ৫ নভেম্বর স্কুলে পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। এতে শিক্ষাক্রমের নানান দিক বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরাও।

চলতি মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন নিয়ে মাউশির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমে পারদর্শিতার সূচক (পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হবে। সূচক ধরে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেবেন শিক্ষকরা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি করে বিষয়। সেগুলো হলো-বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। সব বিষয়েই চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা।

নির্দেশিকার ‘শ্রেণি উন্নয়ন নীতিমালা’ অংশের তথ্যানুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে দুটি বিষয় বিবেচনা করা হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীর স্কুলে উপস্থিতির হার এবং দ্বিতীয়ত, বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতা। ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি থাকলে তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসাবে ধরা হবে এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ের ট্রান্সক্রিপ্টে সবগুলো পারদর্শিতার নির্দেশকে কোনো শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যদি ‘চতুর্ভুজ’ স্তরে থাকে, তবে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের জন্য বিবেচনা করা যাবে না।

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানোর পাশাপাশি হাতে-কলমে শেখা। কিন্তু বছর শেষে উলটো চিত্র দেখছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষকের কাছে মূল্যায়ন রাখায় শিক্ষার্থীদের জিম্মি হয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছেন তারা।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের তথ্য সংরক্ষণ ও রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুতের অ্যাপ ‘নৈপুণ্য’ নিয়ে শিক্ষকদের ২৯টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। অ্যাপটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ৮ নভেম্বর। শিক্ষা অধিদফতর বলছে, এ অ্যাপ নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। সেসব প্রশ্নের উত্তর সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠিয়েছে মাউশি।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/১১/২০২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.