এইমাত্র পাওয়া

অবসরের পরও পেনশনই চান না তারা

ঢাকাঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অবসরে যাওয়ার পরও পেনশনের জন্য আবেদন করছেন না। চাকরিকালীন ইউজার ফির (সেবামূল্য) কমিশন হিসেবে তারা যে টাকা নিয়েছেন তা পেনশনের চয়ে অনেক বেশি। এ কারণে পেনশনের টাকার সঙ্গে সেবামূল্যের কমিশন সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ দেশের বাইরে থাকায় ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. মোশাররফ হোসেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি আমার জানা নেই। আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জেনে আপনাকে জানাতে পারব।’

সম্প্রতি অবসরে গেছেন ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহিনা তাবাসসুম। চাকরিকালীন ইউজার ফির টাকা থেকে যে পরিমাণ কমিশন পাওয়ার কথা তিনি তার থেকে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা বেশি নিয়েছেন। অথচ তিনি পেনশন হিসেবে পাবেন প্রায় ১ কোটি টাকা। তার পেনশনের পুরো টাকা কর্তন করে রাখলেও বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার কাছে আরও ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমিন মিয়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে অবসরে যান। তিনি এখনো পেনশনের টাকা চেয়ে আবেদন করেননি। তার ইউজার ফি থেকে যে পরিমাণ কমিশন পাওয়ার কথা, তা থেকে ১ কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বেশি নিয়েছেন। অথচ তিনি পেনশন হিসেবে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা পাবেন। এই চিকিৎসকের পেনশনের পুরো টাকা কেটে রাখলেও আরও টাকা পাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

শুধু এই দুজন চিকিৎসক নন, তাদের মতো আরও অনেক চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিকালীন ইউজার ফির প্রাপ্য কমিশন থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়েছেন। এ কারণে তারা অবসরে গিয়ে পেনশনের আবেদনই করছেন না। অনেকে আবার পেনশনের অর্ধেক বা তার থেকে কম-বেশি পাচ্ছেন।

স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় বিএসএমএমইউর কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রোগীর কাছ থেকে আদায় করা ইউজার ফি থেকে যা মুনাফা হবে তার একটি অংশ কমিশন হিসেবে পান। আদায় করা সেবামূল্য থেকে রি-এজেট কেনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সব খরচ বাদ দিয়ে যে পরিমাণ মুনাফা হবে, তার ৩০ শতাংশ কমিশন হিসেবে নিতে পারেন তারা। কিন্তু তারা মুনাফার হিসাব না করে ইউজার ফি বাবদ মোট আদায় করা অর্থের ৩০ শতাংশ কমিশন হিসেবে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

বিশ^বিদ্যালয়ের ৫৭টি বিভাগে চিকিৎসকসহ মোট কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন। এর মধ্যে ২০টি বিভাগের চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রোগীর কাছ থেকে আদায় করা ইউজার ফি থেকে কমিশন নিয়ে থাকেন। বিশ^বিদ্যালয়ের আদেশ অমান্য করে এসব বিভাগের সংশ্লিষ্টরা প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা বেশি নিয়েছেন। এর মধ্যে আয়কর বাবদ সরকারের পাওনা ২০ কোটি ২৩ হাজার ৮৬১ টাকাও রয়েছে। স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিএসএমএমইউ ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কমিশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০০৭ সালের ২৭ মে বিশ^বিদ্যালয়ের ২৫তম সিন্ডিকেট সভায়। ওই সভার সিদ্ধান্ত ছিল ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং বিভিন্ন অপারেশনাল প্রসিডিউর থেকে পাওয়া অর্থের বিভিন্ন রি-এজেট এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সংশিষ্ট প্রচলিত অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে যা লাভ হবে তার ৩০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টনের। এরপর একই বছরের ৪ অক্টোবর কমিশন বণ্টনের বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। যদিও প্রশাসনিক আদেশে কমিশন গ্রহণের বিষয়টি ২০০৭ সালের ২৭ মে কার্যকর বলে গণ্য করা হয়। ওই সময় থেকেই তারা আদেশ অমান্য করে লভ্যাংশের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ নেওয়া শুরু করেন। এরপরই ২০০৭ সালের ২৭ মে থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ২০টি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ২০০ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা কমিশন নিয়েছেন। এর মধ্যে তাদের কমিশন পাওনা ছিল ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা; অর্থাৎ তারা প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা বেশি নিয়েছেন।

কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন আহমেদ আবু সালেহ নামে এক চিকিৎসক। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কমিশন স্থগিত রাখার আদেশ দেয়। একই সঙ্গে যারা প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত নেওয়া অর্থ ফেরত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা দিতে আদেশ দেয়।

হাইকোর্টের ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যারা প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি অর্থ নিয়েছেন, তাদের সেই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে ফেরত দিতে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর আদেশ জারি করে রেজিস্ট্রার অফিস।

ওই আদেশ দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগ টাকা ফেরত দেয়নি। উল্টো এখনো কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে পকেটে ভরছেন।

কমিশনের নামে নেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত আনা, কমিশন প্রদানসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিশন হিসেবে নেওয়া অর্থের পরিমাণ নির্ধারণে একাধিক কমিটি করা হয়। এর মধ্যে প্রথম কমিটি হয় ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর বিশ^বিদ্যলয়ের সাবেক প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) মো. শহীদুল্লাহ সিকদারকে প্রধান করে। কমিটি একাধিকবার বৈঠক করলেও কোনো টাকা ফেরত আনতে পারেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসএমএমইউর ২০টি বিভাগে ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ৭৫২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৭ টাকা আয় হয়। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪২৯ কোটি ৬০ লাখ ৫৩ হাজার ৫০২ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২৩ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮১৪ টাকা। নিট মুনাফা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক-কর্মচারীরা কমিশন পাবেন ৮৩ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার ৭০১ টাকা। এই টাকা থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে পাবেন ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা। অথচ তারা কমিশন নিয়েছেন ২০০ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা; অর্থাৎ প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা বেশি নিয়েছেন। এই টাকার আয়করের ২০ কোটি ২৩ হাজার ৮৬১ টাকাও রয়েছে, যা লোপাট করা হয়েছে।

দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিয়মিত বেতনের বাইরে কমিশন হিসেবে মাসে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। গত ৩১ আগস্ট প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করেছে দুদক। এরপর ১১ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। এ পর্যায়ে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক। দেশ রূপান্তর

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/১০/২০২৩   

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.