এইমাত্র পাওয়া
ড . কে এম আতিকুর রহমান।

গবেষণায় আমাদের আগ্রহ কম কেন?

ড. কেএম আতিকুর রহমান: ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিটিক্স, চীনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২২ সালে গবেষণায় তাদের মোট খরচ হয় ৪৫৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঐ বছর তাদের পবেষণাপত্র প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ১০০,৯৮৯১ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল ৭০২,৮৪০। এখানে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ১৩,৪৮৩, এমনকি পাকিস্তানও আমাদের উপরে অবস্থান করছে ৪১,৯১৩টি প্রকাশনা নিয়ে। উপরিউক্ত প্রকাশনা ও গবেষণা খরচ বলে দিচ্ছে আমাদের অবস্থান কোথায়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে বিশ^দ্যিালয় -প্রতি গবেষণা ব্যয় ছিল গড়ে ১.২২ কোটি টাকা। গবেষণার খারাপ অবস্থার জন্য আমাদের বরাদ্দ, অবকাঠামোর অপ্রতুলতার সঙ্গে অনীহার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শিক্ষা বাজেট যেখানে মোট বাজেটের ১.৮৩%, সেখানে গবেষণা বরাদ্দ কী করে বেশী হতে পারে। সাধারণত বিশ^বিদ্যালয়, বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ইনস্টিটিউটসমূহ গবেষণা কাজ পরিচালনা করে। কিন্তু বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার খড়াই শুধু লক্ষ্য করা যায় না, বিশ^ র্যাং কিং-এ তাদের উল্লেখযোগ্য অবস্থানই পরিলক্ষিত হয় না। কেন এই অবস্থা? মূলত বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এতটাই দুর্বল যে ইথিওপিয়া ও সুদানের বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গেও তাদের তুলনা করা কঠিন। কারণ ইথিওপিয়াতে পিএইচডি ডিগ্রী ও ভাল প্রকাশনা ছাড়া বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে পদোন্নতির কোন সুযোগ নেই। ভাল মানের প্রকাশনা বা বৈজ্ঞানিক প্রেজেন্টেশন পেপার ছাড়া শিক্ষক পদের এন্ট্রি লেভেলে আবেদন করারও কোন সুযোগ নেই।

আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থীকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যোগ্যতা কেবলই উচ্চ জিপিএ। তাদের না থাকে পিএইচডি, না থাকে প্রকাশনা এবং না থাকে গবেষণা অভিজ্ঞতা। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। পৃথিবীর কোন বিশ^বিদ্যালয়ে পরীক্ষার গ্রেডকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবেসাইটে প্রবেশ করলেই আমরা তা দেখতে পারি। এগুলো দেখেও কী আমরা কিছু শিখবো না? বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ বা পদোন্নতির যোগ্যতা হলো পিএইচডি, পোস্ট-ডক্টোরাল সম্পন্ন করা, প্রকাশনা, প্রেজেন্টেশন, সাইটেশন ও প্যাটেন্ট। কিন্তু আমাদের দেশে হয়ত অন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এসব যোগ্যতাকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয় না। যেহেতু গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, তাই তারা মনে করেন পাঠদান করাই মূল বা একমাত্র দায়িত্ব। তাই তারা গবেষণায় নেই, আছে কেবল পাঠদানে। পাঠদানের যোগ্যতাও আমাদের বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রশ্নাতিত নয়। হ্যাঁ, এতে হয়তো বেশ কিছু শিক্ষক আছেন ব্যতিক্রম। সহকারি অধ্যাপক, সহযোগি অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য শর্ত হিসেবে বাংলাদেশে কিছু প্রকাশনার কথা বলা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, প্রতিটি বিভাগ এবং অনুষদ কিছু জার্নাল প্রকাশ করে যেগুলোকে কেবল প্রমোশন প্রকাশনা বলা যেতে পারে। নিজেরাই লেখক, নিজেরাই রিভিউয়ার এবং নিজেরাই প্রকাশক। এমনকি একজন শিক্ষার্থীও ইনডিপেন্ডেন্টলি ঐ জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারে না। আমাদের বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কারোরই ভাল ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশনা আছে বলে জানা নেই। একটু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় বুয়েট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, গবেষণার ক্ষেত্রে কম-বেশী অবদান রাখছে। যেমন: আইবিএস নয়িমতিভাবে অন্তত কিছু এমফিল, পিএইচডি এবং পাশাপাশি কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করছে। অন্যদিকে কৃষি গবেষণায় আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ ভাল করছে বলে মনে হয়। যেমন: উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ উদ্ভাবন, খড়া, লবণাক্ততা সহনীয় ফসলের জাত আমাদের কৃষি গবেষকগণ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই আমরা কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। বাংলাদেশে অবস্থিত আইসিডিডিআরবি একটি আর্ন্তজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখানে অনেক ভাল গবেষণা হয় তার প্রমান আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ্য করছি। প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের বেশ গবেষণা প্রবন্ধ অনলাইনে চোখে পড়ে।

অবশ্য বর্তমানে বাংলাদেশে গবেষণাপত্রের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বৈশি^ক পরিস্থিতির তুলনায় তার অবস্থান খুবই নগণ্য। বলা হয়ে থাকে, পেটে ক্ষুধা নিয়ে গবেষণা হয় না। কথাটি হয়ত আংশিক সত্য। কিন্তু আমরা এ চিত্রও খুঁজে পাই যে, প্রতিবছর অনেক বিশ^বিদ্যালয় হতে গবেষণা ফান্ডের টাকা খরচ হয় নি, তাই ফেরত গিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রতিবেদন দেখলেই আমরা তা জানতে পারি। অনেক বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণা হোক বা না হোক মাসিক হিসেবে শিক্ষকগণ গবেষণা ভাতা নিচ্ছেন। নির্দিষ্ট গবেষণার বিপরীতে বোনাস বা পুরস্কার বা প্রকাশনা ফি বাবদ সাধারণত গবেষণা ফান্ড ব্যয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে চিত্রটা ভিন্ন। ফলে গবেষণা কম হয় কিন্তু শিক্ষকগণ মাসিকভাবে গবেষণা ভাতা প্রাপ্য হচ্ছেন । অনেক গবষেণা প্রজেক্টের টাকা কম্পিউটার ক্রয়, বিদেশ ভ্রমণ করেই খরচ করা হচ্ছে। অনেক গবেষণা প্রজেক্টের জন্য সময় বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র দুই মাস। ফলে ডেস্ক রিপোর্ট তৈরি করে গবষেকরা জমা দিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন। গবেষণা রিপোর্ট নিয়ে তেমন প্রশ্নও তোলা হচ্ছে না বা রিপোর্টটি পড়া হয়েছে বলেও মনে হয় না। বিষয়টা এমন যে টাকা খরচ হলেই হয়। অন্য কিছু হলো কি হলো না, তা খুব দেখার বিষয় নয়। টাকাটা খরচ হলে কাগজপত্র ঠিকঠাক হয়ে গেলেই কেল্লা ফতে।

সেমিনার ও কনফারেন্সে বিশ^ব্যাপী গবেষণা ফলাফল প্রেজেন্ট করা হয়। এর ফলে সবাই নতুন জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণা সেমিনার বা সম্মেলন এতই কম হয় যে, তা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। হাতে গোণা কিছু সেমিনার হলেও সেগুলো গতানুগতিক টাইপের হয়ে থাকে। নতুন কোন জ্ঞানের আভা সেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ফলে অসম্ভব মেধা থাকার পরও আমাদের শিক্ষার্থীরা গবেষণা পদ্ধতিতে খুবই দুর্বল। কেউ কেউ বিদেশী বিশ^বিদ্যালয়ে গিয়ে গবেষণা শিখছে, কিন্তু দেশের ফেরার পর সেই আগের অবস্থানেই চলে যাচ্ছে। কারণ গবেষণার সংস্কৃতি নেই; বরং নানাভাবে এটাকে ডিমরালাইজও করা হয় । একজন গবেষক হওয়ার জন্য যে মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হয়, আমাদের অধিকাংশেরই সেটা করার আগ্রহ নেই। কারণ তারা মনে করে, গবেষক হলে সমাজে দাম পাওয়া তো যাবেই না বরং হাসি-ঠাট্টার পাত্র হতে হবে। তাই আমাদের শিক্ষার্থীরা বিসিএসের পিছনে দৌঁড়াচ্ছে। এখানে বাড়ী-গাড়ী, ক্ষমতা, ও মর্যাদা সবই আছে। শুধু শুধু গবেষক হয়ে কষ্ট করবো কেন। বর্তমানে অনেকেই পিএইচডি করছেন। এই পিএইচডি যতটা না গবেষণার জন্য ততটাই আর্থিক বা প্রমোশন সুবিধার জন্য। তবে এটাও মন্দের ভালো। তবুতো তারা একটা গবেষণা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকেই করছেন সমাজে সম্মান বাড়ানোর জন্য।

আমাদের উন্নয়ন আরো টেকসই হতে পারতো যদি তা গবেষণার উপর নির্ভর করে বাস্তবায়ন করা যেতো। যারা গবেষণা জানে তারা যোগ্য পদে বা যোগ্য জায়গায় আসীন হতে পারছে না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। বাংলাদেশে ভাল মানের তেমন কোন জার্নাল আছে তা আমার জানা নেই; যেখানে নতুন নতুন প্রকাশনা আসবে; নতুন গবেষক তৈরি হবে। অন্য দেশের ভাল জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনা কতটা ঝুক্কি-ঝামেলার তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। বড় প্রকাশনা ফি ছাড়া দ্রুততম সময়ে ভাল প্রবন্ধ প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমাদের কী সেই সামর্থ্য আছে? আমাদের ব্যবসায়িক কোম্পানীগুলো এক্ষেত্রে স্পন্সর করতে এগিয়ে আসতে পারে। এই স্পন্সরশীপকে তারা সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি আকারে সরকারকে দেখাতে পারে। ট্যাক্স হলিডেও তারা পেতে পারে। এতে কোম্পানীগুলোর লাভ ছাড়া কোন লোকসান নেই। বিশে^র অনেক কোম্পানী তা করছে।

অনার্স-মাস্টার্স কলেজগুলোতে শিক্ষকদের প্রমোশন, বদলী, পদায়নে গবেষণা অভজ্ঞিতাকে শর্ত আকারে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এটা স্বল্প পরিসরে হলেও শুরু করা যেতে পারে। লজিষ্টিক সাপোর্টের যেহেতু অভাব রয়েছে; তাই বড় পরিসরে এটা হয়ত সম্ভব হবে না। প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় এমনকি কিছু বড় কলেজেও এমফিল, পিএইচডি কোর্স চালু করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই শক্ত নীতিমালা বা শর্ত আরোপের মাধ্যমেই তা করা উচিৎ। এটা হলে অন্তত গবেষণার একটি পরিবেশ বা সংস্কৃতি চালু হবে। গবেষণার জন্য বিশ^বিদ্যালয়ে বৃত্তির সংখ্যা, প্রজেক্টের সংখ্যা বাড়ানো উচিৎ। এছাড়া গবেষণা সেন্টার, ইনস্টিটিউট বাড়ানো দরকার। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা হয়ত বাড়বে, তবে কিছু একটা গবেষণার পরিবেশ তৈরি হবে। চাকরী প্রাপ্তি বা পদোন্নতির জন্য প্রকাশনা বা সাইটেশন শর্ত আকারে জুড়ে দিলে এমনিতেই গবেষণা শুরু হবে। মোদ্দাকথা গবেষণা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন পৃথিবীর কোথাও সম্ভব নয়।

লেখকঃ  সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/০৮/২০২৩   

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.