এইমাত্র পাওয়া

ছাত্ররাজনীতির সেকাল-একাল

আশির দশকের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় থাকার সুবাদে ছাত্র সংগঠনের বাইরে থেকে ছাত্র রাজনীতির অনেক ঘটনা পর্যবেক্ষণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নব্বইয়ের আন্দোলন, জিহাদ হত্যা এবং অন্যান্য ঘটনা আমার সামনেই ঘটেছে। সেকালের ছাত্র রাজনীতির অনেক ঘটনা মনে পড়ে।

ছাত্রনেতাদের জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। অনেকটা কষ্টের। সে সময় তাদের মধ্যে ছিল ত্যাগের রাজনীতি। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতি ভোগের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। তখনকার অনেক ছাত্রনেতাকে পর্যবেক্ষণ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল থেকে নেতারা হেঁটে মধুর ক্যান্টিনে সকালে নাশতা করতেন।

নাশতায় শিঙাড়াই খেতেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে নেতারা হেঁটে মিছিল করে মধুর ক্যান্টিনে আসতেন। রিকশা ভাড়ার টাকাও নেতার কাছে ছিল না। অতি সম্প্রতি দেখেছি, পদচ্যুত একজন ছাত্রনেতা, যিনি একটি দামি সাদা গাড়িতে যাতায়াত করতেন। তার আগে-পিছে থাকত সত্তর-আশিটি মোটরসাইকেল। এমন চিত্র প্রতিদিনই দেখেছি।

গাড়ির বহর নিয়ে সে নেতা ধানমন্ডির দিকে যেত এবং রাত একটা-দেড়টার দিকে আবার ক্যাম্পাসের দিকে আসত। তাদের এসব কর্মকা-ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাসের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ধানমন্ডি এলাকার জনসাধারণ চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা জনদুর্ভোগ এবং হয়রানি পর্যায়ে পড়ে।

সেই সময়ের রাজনীতির সঙ্গে ত্যাগের আর এ সময়ের ভোগের পরিবর্তন এ থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। ব্রিটিশ আমল থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ছাত্ররাই আমাদের একটা বড় শক্তি। আমাদের যখনই কোনো বিপর্যয় নেমে আসে, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে আসে ছাত্ররা। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের আন্দোলন এবং সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের পর জাতি একটি দীর্ঘমেয়াদি সামরিক শাসনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটি ছাত্রদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমানেও দেশ গড়ার কাজে ছাত্ররা অবদান রেখে যাচ্ছে। শুধু আমাদের বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্ররা বড় ভূমিকা রাখছে। যেমন সম্প্রতি হংকংয়ে ছাত্ররাই আন্দোলন করছে, এর আগে ছাত্র রাজনীতি না থাকা সত্ত্বেও।

কিন্তু চীনে বর্তমানে তথাকথিত ডেমোক্র্যাটিক প্রসেসের যতটুকু অগ্রগতি, সেটাও তিয়েনআনম্যান স্কয়ারের ছাত্র আন্দোলনেরই ফল। ক’দিন আগে সারা পৃথিবীতে জলবায়ু নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, সেটাও ছাত্ররাই করেছে। ছাত্র রাজনীতি কোথাও নেই, এ কথা বলা যাবে না। আমাদের দেশে তা বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির ধরন, কাঠামো অর্থাৎ ফর্মটা কেমন হবে? আমাদের এক সময় কালচার ছিল রাস্তায় সেøাগান দিতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে, গাড়ি ভাঙবে এবং মিলিটেন্সি শো করতে হবে, ছাত্ররা জীবন দেবে, জীবন বাজি রাখবেÑ এ রকম ছাত্র দরকার ছিল, নেতার দরকার ছিল।

কিন্তু আমাদের কি এখন জীবন দেওয়ার দরকার আছে? আমরা তো এখন জীবন রেখেই দেশ গড়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেব। দেখতে হবে বর্তমানে কারা ছাত্র নেতৃত্বে আসছে। আগের মতো বেশি ত্যাগেরও দরকার নেই। আপনার যে স্বাভাবিক জীবন, সেটার মধ্য থেকেই মেধার এবং উদ্ভাবনী শক্তির যে সংমিশ্রণ হবে এ দিয়েই ছাত্ররা সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেন। ছাত্রলীগের ছেলেদের কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়বে, ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়বে।

এসব পড়ে সেই ত্যাগের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হবে। আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রগ কাটার রাজনীতি প্রচলিত ছিল। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি সেই রগ কাটার রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময়ে শিক্ষার্থীকে হত্যা করে ড্রেনে ফেলে রাখা হতো, বহু ছাত্রকে ড্রামের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হতো। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ছিল গোলাগুলি, বিভিন্ন গ্রুপিং যেমনÑ অভি বাহিনী, ইলিয়াস বাহিনী।

দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়ে আবার সেই অপসংস্কৃতি ফিরে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ না হয়ে কিছু নেতা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির, মানুষের রগ কাটা, টর্চার সংস্কৃতি যুক্ত হয়েছে কিছু দুর্বৃত্তের মাধ্যমে। এ অপকর্মটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নামে হওয়ার কারণে আমিও লজ্জাবোধ করি। ছাত্র রাজনীতিকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেল, একই অবস্থা যুবলীগেও। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যুদ্ধ করে ফিরে আসেন তরুণরা। তারা তখন কি করবেন? বঙ্গবন্ধু তাদের দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একটি সংগঠনের মাধ্যমে একীভূত হতে বলেন।

আর সেই যুবলীগের কিছু নেতা এখন ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। লাখ লাখ যুবক এখনও আছে, যারা এ ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়। লাখ লাখ যুবক আছে, যারা যুবলীগ করে কোনো বেনিফিট পাননি, দিনের খাবার দিনে জোগাড় করতে পারেন না। একটা কনস্টেবলের চাকরি পায়নি, এখন পর্যন্ত এ রকম কর্মী যুবলীগে আছে। কিন্তু তারা সংগঠনটিকে ভালোবাসে। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিল, সেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ, যারা আদর্শ নেতৃত্বের একটা ফোরাম হতে পারত, এ জায়গাগুলোকে কলুষিত করলেন কয়েকজন নেতা। এটা নেতৃত্ব এবং নেতাদের দুর্বলতা।

এখন সংগঠনকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার যে প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা হচ্ছে, আমি মনে করি তা একেবারেই বুমেরাং হবে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব উঠেছে। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। লেখা আছে ‘ধূমপান ও রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস’। সেখানে কি ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে না? ভেতরে ভেতরে জঙ্গিবাদী ছাত্র সংগঠন যেগুলো আছে, সেগুলো গড়ে উঠেছে এবং জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিযবুত তাহরীর উৎপত্তি হয়েছে। দলের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি থাকলে এ দুর্বত্তায়ন হবে। ইচ্ছে করলেই লেজুড়বৃত্তি কেটে দেওয়া যাবে না। বহুরকম যোগাযোগ থাকবে।

বাংলাদেশে বহু সংগঠন আছে, যেগুলোর মূল দল নেই। হিযবুত তাহরীর মূল দল কোনটি? এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হলেও এখনও আছে। বিভিন্ন জায়গায় এ সংগঠনগুলো সংগঠিত। যে ঘটনা বুয়েটে ঘটেছে, এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়। এ ঘটনার সঙ্গে শিক্ষক রাজনীতির কথাও উঠেছে। বুয়েটের কোনো শিক্ষক দলীয় রাজনীতি করেন, তা আমি দেখিনি। বুয়েটের শিক্ষকদের মধ্যে একজন রাজনৈতিক নেতার নামও পাওয়া যাবে না। এখানে ব্যাপার হচ্ছে, যারা হাউস টিউটর ছিলেন, প্রভোস্ট ছিলেন, তাদের গাছাড়া ভাব। একজন ছাত্র খুন হয়ে গেল, অথচ উপাচার্য ক্যাম্পাসে গেলেন না, জানাজায় গেলেন না।

এটা কী করে হলো আমার বোধগম্য নয়। পরে অবশ্য উপাচার্য তার অনুপস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ঝিনাইদহে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। তাকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে এনে চিকিৎসা করেছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সাত আট বছরে কোনো ছাত্রকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন কারণে যারা মারা গেছেন, প্রত্যেকটা ছাত্রের লাশ পাঠানো থেকে আরম্ভ করে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা, টাকা-পয়সা দেওয়া, এমনকি দুটি বাস দিয়ে বিভাগীয় শিক্ষক ও সহপাঠীদের লালমনিরহাট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কাজগুলোও আমরা করেছি।

অথচ বুয়েট প্রশাসনের যেভাবে হ্যান্ডেলকরণ তা কোনো অজুহাতেই দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বুয়েটের শিক্ষকরা রাজনীতি করেন, কোন দলের কোথাকার নেতা আমার জানা নেই। অতএব গা-ছাড়া ভাব যে ব্যাপারটা, সেটা হয়েছে বুয়েটে। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে বিশ-পঁচিশজন মেধাবী ছাত্রের জীবন বিপন্ন। বুয়েটে যারা আসে, তারা মেধাবী তো অবশ্যই। একজনকে হত্যা করা হয়েছে, যেটার জন্য আমরা সবাই মর্মাহত, নিন্দা জানাচ্ছি, তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু এ ঘটনায় এরই মধ্যে বিশজনের মতো গ্রেপ্তার হয়েছে।

এর মধ্যে একজন ভ্যানচালকের ছেলেও গ্রেপ্তার হয়েছে, যে মূল আসামিদের একজন। হয়তো তার মৃত্যুদ- বা আজীবন শাস্তি হয়ে যাবে। মেধাবীদের এভাবে নৈতিক স্খলনের পথে নিয়ে যাওয়ার পথ আমরা যারা নেতৃত্বে কিংবা পদপদবিতে আছি, তারাই সৃষ্টি করলাম কি না এটাই প্রশ্ন।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading