উজ্জ্বল কুমার বিশ্বাস
দেশের রাজধানী শহর ঢাকাতে অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনগুলোতে পরিচিত একটি চিত্র হলো ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সামর্থ্যের বাইরে বইয়ের ভারী ব্যাগ বহন করে স্কুলে প্রবেশ করছে। বিদ্যালয় ছুটির পর দেখা যায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শিক্ষার্থীরা ব্যাগগুলো পিঠে বহন করে বিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সাথেই তাদের মায়েরা আসেন তাদের বিদ্যালয় থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অভিভাবকগণ তাদের সন্তানের কষ্ট লাঘব করার জন্য অনেক সময় তাদের সন্তানের ব্যাগগুলো বিদ্যালয়ের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু গেট থেকে শ্রেণিকক্ষ পর্যন্ত ব্যাগগুলো তাদের নিজেদেরই বয়ে নিয়ে যেতে হয়। শ্রেণিকক্ষ বহুতল ভবনে হলে কষ্টের এই মাত্রাটা আরও তীব্র হয়।
অভিভবাকগণকে তাদের সন্তানের জন্য বোর্ড নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও সহপাঠের নামে আরও বিভিন্ন ধরনের বাড়তি বই, খাতা, পেন্সিল, পানির বোতল ইত্যাদি ব্যাগে নিয়ে যেতে হচ্ছে। স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা যখন ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে বইয়ের ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয় তখন অভিভাবকগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে ব্যাগটি নিজের হাতে নিচ্ছেন। যেহেতু মা অভিভাবকগণ বেশি আসেন তাদের সন্তানকে আনা নেয়ার জন্য, তাই অনেক সময় তারাও সম্পূর্ণ পথ ব্যাগটি বহন করতে পারেন না। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকেই ব্যাগ বহন করে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। যারা ধনী পরিবারের সন্তান, যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীকে রিকশায় বা পায়ে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছাতে হয়।
১ম থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের বই, উপকরণ, খাবার সামগ্রী এবং ব্যাগের ওজনসহ প্রায় ৭-৮ কেজি বহন করতে হয়। নিয়মিত এই কাজে শিশুর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কখনও কখনও সন্তানের বেটে হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে একজন শিশুর নিজের ওজনের ১০ ভাগের ১ ভাগ বহন করা উচিত। অন্যথায় তার পিঠে, পায়ে, ঘাড়ে নিম্নোক্ত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
১. ভারী ব্যাগ মেরুদ-ের গোড়ার অংশটিকে সামনের দিকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। গলার পিছনে এবং পিঠের পেশীর বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাথা নাড়তে সমস্যা হয়।
২. আরও একটি সমস্যা হলো ঘাড়ের পেশী শক্ত হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে তা ছিঁড়ে যায়। লিগামেন্টগুলোর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে যায়। ঘাড়ের পেশীর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ঘাড়ে অসহ্য যন্ত্রণা হয়।
৩. মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় মেরুদ-ের নিচের দিকে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। সেখানকার পেশীগুলো অতিরিক্ত শক্ত হয়ে যায়। পিঠের নিচের অংশেও ব্যথা হয়।
৪. মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় দেহ সোজা রাখার দায় বর্তায় পশ্চাৎ দেশের পেশীগুলোর উপর। সেই পেশীগুলোর অত্যাধিক চাপ পড়ে যা ওই পেশির স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
৫. সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া শরীরের হাঁটা চলার স্বাভাবিক ছন্দ রাখতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে দুই হাঁটুর উপরে। এতে অনেকেই অল্প বয়সে হাঁটুর ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্র এবং মহামান্য হাইকোট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশেও উল্লেখ করা হয়েছে শিশুকে তার ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী বইয়ের ব্যাগ বহন করানো যাবে না। কিন্তু সেই নিয়মের প্রতিপালন অনেক ক্ষেত্রেই হয় না। বর্তমানেও সকল ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদিত বইয়ের বাইরে কোনো বই না পড়াতে নির্দেশনা রয়েছে।
একজন শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণিতে বোর্ড অনুমোদিত ৬টি বই নিয়ে লেখাপড়া করে। প্রাথমিক স্তরে শিশুর পারগতার স্তর, সামর্থ্য অনুযায়ী ৬টি বিষয়ই তার জন্য উপযুক্ত । অথচ যখন একজন শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় তখন তাকে ১২টি বিষয়ে লেখাপড়া করতে হচ্ছে যা যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে করে শিক্ষার্থী হঠাৎ করেই এক ধরনের কঠিন অবস্থার মধ্যে পরে যায়। এই চাপ নিতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। এই অবস্থা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চলমান। অথচ শিশুর পারগতা বা সামর্থ্য ধারাবাহিকভাবে স্থরে স্তরে বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ এই চাপে যাতে কোনো শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, ভয় বা লেখাপড়ার প্রতি অনীহা না জন্মে এ জন্য সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। সংশ্লিষ্ট কমিটি যাচাই বাছাই করে ২০১৮ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার জন্য ১২টি হতে ৪টি বিষয় কমিয়ে ৮টি বিষয় নির্ধারণ করে। বাস্তবে এ সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থী শিক্ষক, অভিভাবকসহ সকলের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। এতে করে শিক্ষার্থীর উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ যেমন কমলো, তেমনি বইয়ের ব্যাগের ভারও অনেকটাই কমেছে।
মূলত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অধিক লাভের আশায় শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের বাইরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদিত বই ছাড়াও সহপাঠের নামে অতিরিক্ত বিভিন্ন বই, খাতা, পেন্সিলসহ বিবিধ উপকরণ সংগ্রহ করতে বাধ্য করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারি আইনের যথাযথ প্রয়োগ হওয়া দরকার। শিক্ষক অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শুধু আইন দিয়ে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকে যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যকেও সচেতন করে তাহলেই এ সমস্যা হতে উত্তোলন সম্ভব। অন্যথায় জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার যারা হবে, তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ দীর্ঘ মেয়াদে বাধাগ্রস্ত হবে।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.