রুম নম্বর-২২২
আবিরের বাড়ি চট্টগ্রাম। একদম যে চট্টগ্রাম শহরে তা নয়, চট্টগ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে সিলেটের সীমান্ত শহর জাফলং এর কাছে। ছোটবেলা থেকেই সে বড় হয়েছে ছোট-বড় রং-বেরং এর পাথরের দেশে। পাথরগুলোর ঠকঠক শব্দ, বাতাসের স্নিগ্ধ সুর এবং ঝরণার শনশন করে বয়ে চলার আওয়াজ আবিরের খুব কাছের বিষয়। আবির পড়াশুনায় বেশ ভাল। স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে আজ সে চ্যান্স পেয়েছে চট্টগ্রামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা কিংবা খুলনায় গিয়ে পড়ার তার কখনোই ইচ্ছা ছিল না। কারণ তার কেন জানি মনে হয় সে যদি চট্টগ্রাম ছেড়ে দূরে যায়, তাহলে সে বুঝি পাগলই হয়ে যাবে। কারণও ওই একটাই প্রকৃতির সাথে তার বেজায় সখ্যতা। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার দিন চলে এসেছে। আবিরের কি মজাটাই না মনে হচ্ছে! বিশ্ববিদ্যালয়ে তার থাকার ব্যবস্থা হলো বায়েজিদ হলের রুম নম্বর-২২২ এ। রুমটা বেশ বড়, পরে সে জানতে পারল ওই রুমে নাকি সে একাই থাকবে। ব্যাপার কী তাহলে? খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল তার রুমমেটরা কোনো এক বিশেষ কারনে আসার সাথেই তাদের রুম বদলে ফেলেছে । প্রথমে একটু মন খারাপ হলেও আবির ঠিক করে নিল সে ওই রুমটাতেই থাকবে। কারণ রুমটার পেছনেই ছিল একটা ছোট্ট ঝরনা! জাফলং এর মত অতটা না হলেও কিছুটা ঝরনার আওয়াজ শুনতে পাওয়ার জন্যই এই রুমটাই তার জন্য শ্রেষ্ঠ। বেশ কয়েক বছর ধরে এই রুমে কেউ থামেনি। তাই রুমটা অনেকটা অপরিষ্কার হয়ে আছে। আর যারা ছিল কিছুদিন, তাদের এই ঝরনার শব্দে অসুবিধা হওয়ায় তারাও রুম বদলে ফেলেছে। কিন্তু আবিরর ক্ষেত্রে এসবের ঝামেলা নেই।
এভাবেই শুরু হলো আবিরের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি। সুন্দরভাবেই কাটছিল আবিরের সময়। তবে ঝামেলাটা শুরু হলো ঠিক ২(দুই)মাস পর। কয়েকদিন ধরেই সে জানালা দিয়ে ঝরনার শো শো শব্দের পরিবর্তে এক ব্যক্তির ভাঙা গলায় জোরে জোরে চিৎকার শুনতে পায়। এমন মনে হয় যেন কেউ বাঁচার জন্য সীমাহীন আর্তনাত করছে, সাহায্য চাইছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই আর্তনাত কোনো এক পিশাচের ভয়ংকর গানে বদলে যায়। এমন গান শুরু হয়, যাতে সারা শরীরের লোম কাটা হয়ে কপাল থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করে। আবার মধ্যরাতে সব ঠিক হয়ে যায়। যেন কিছুই হয়নি। এভাবেই চলতে থাকে আবিরের ভয়ংকর রাতগুলি। কিছুদিন পর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। এবার শুরু হয় নতুন এক ভয়াবহ কান্ড। চারিদিক দিক থেকে বের হতে হয়ে আসতে থাকে এক ভীষণ বাজে গন্ধ । যে গন্ধ নাকে গেলেই যে কেউ বমি করে দিবে সাথে সাথে। তবে আবিরের বমি আসে না । সে সারারাত জেগে জেগে ভাবে এসবের কারণটা কী? আবির ঠিক করে, যদি রাতেও এমন ঘটনা আবার ঘটে তাহলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে সরাসরি ওই ঝরনার কাছে যাবে। কিন্তু আবিরের আর সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। কারণটা ওই রাতের পর পরের ১(এক)মাস সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই হঠাৎ করে সব কিছু ঠিক যাওয়ার পিছনের কারণটা আবির ঠিক বুঝতে পারে না। পেছনের আসলে ঘটনাটি কী? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ওই ঝরণার কাছে যাওয়ার নিয়ম নিষিদ্ধ করেছে ৩(বছর) হয়েছে। তবুও আবিরের তীব্র ইচ্ছা ওই ঝরণার কাছে একটিবার হলেও যাওয়া। সরাসরি অনেকভাবে সে আবেদন করেছে সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার জন্য। কিন্তু সবখানেই উত্তর না এসেছে। কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে ওখানে যেতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আবির সন্ধ্যেবেলায় সবার চোখের অগোচরে ঝরণার কাছে পৌঁছাল। কী সুন্দরই না দেখতে সেই ঝরণা? হাতে বেশি সময় নেই। তাই আবির জলদি ঝরণার চারদিকের কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।
রাতে আবির জানালার কাছে বসে টেবিলে ছবিগুলো গভীরভাবে দেখছে। এমন সময় জানালার সামনে চারিদিক থেকে ধোঁয়া আসতে শুরু করে। তবে এ ধোঁয়া সাদা নয়, রক্তের মত লাল রঙের ধোঁয়া! তবে এসব দেখে সে ভয় পায় না বরং বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে। সাধারনত: পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষজন একটু বেশিই সাহসী হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়া সরে যায়। আবির দেখে তার টেবিলে একটা পুরানো ডায়েরি রাখা। ডায়েরি থেকে সেই বিকট গন্ধ বের হচ্ছে। আবির সাবধানে ডায়েরিটির পাতা বের করে। সেখানে যা লেখা ছিল তার জন্য আবির ঠিক প্রস্তুত ছিল না। লেখাটা এমন-
মানছি তোমার বেজায় সাহস, তবে মৃত্যু যে অনিবার্য !
লেখাটা ঠিক স্পষ্ট নয়, তবে মনে হচ্ছে সদ্য লেখা। অনেকটা লাল রক্ত দিয়ে লেখা বলে মনে হচ্ছে। আবিরের সন্দেহ আরও বেশী বেড়ে যায় এবং হঠাৎ করে ডায়েরিটাও উধাও হয়ে যায়। এরপর থেকেই আবির সম্পূর্ণ সতর্ক হয়ে যায় এবং ব্যাপারটা তার কাছে কিছুটা খোলাসে হয়ে ওঠে। এভাবে প্রায় দিনই ধোঁয়ায় ভরে যেত ঘর আর ডায়েরিতে নানানভাবে হুমকি দেওয়া হতো আবিরকে। তবুও আবীর দমবার পাত্র নই। সে অনেকটা ধরে ফেলেছে এই ভৌতিক রহস্যের পিছনে চলা কারসাজি। আজ রাতে যখনই চারিদিকে ধোঁয়া চলে এল ঘরে, আবির তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে পাচিল টপকে ঝরণার কাছে গিয়ে পৌঁছায়। আবির যেমনটা ভেবেছিল ঠিক তেমনটাই চলছে এই ঝরণার কাছে। ঝরণার পিছনেই আছে গুপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি। যা এতোদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে কেউ জানতে পারেনি। নির্দিষ্ট সময় পর পর গভীররাতে এখানে সেই গ্যাস অবৈধভাবে তোলা হয়। আর রুম নম্বর ২২২ থেকে সরাসরি এই দৃশ্য দেখা যায় বলে ওই রুমের কোনো শিক্ষার্থীকে বেশিদিন ওই রুমে টিকতে দেওয়া হয় না। আবির চুপিসারে ঝোঁপের আড়াল থেকে সবকিছু ভিডিও করছিল ফোন থেকে। এমন সময় আবিরের শার্টের কলার টেনে একজন লোক টানতে টানতে তাকে নিয়ে যায় ওই ঝরণার কাছে। কয়েকজনের হাতে পিস্তল। একজন মোটা দেহের ভয়ংকর লোক হুংকার দিয়ে বলে উঠল- “গুলি চালিয়ে শেষ কর ব্যাটাকে। ব্যাটার সাহস কত?” সাটার টেনে যখনই আবিরের মাথায় পিস্তলটি রাখা হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পুলিশের গুলি এসে লাগল পিস্তলধারী সেই লোকটির হাতে। সবাই পালাতে চেষ্টা করলেও চারিদিক থেকে পুলিশের ফোর্স ঘেরাও করে রাখায় কেউ পালাতে পারল না । ইতিমধ্যে ঝরণার চারিপাশে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে গেছে। সবাই অবাক হয়ে দেখছে আবিরকে। পুলিশের কর্মকর্তা এসে আবিরকে ধন্যবাদ জানান, তাদের আগে থেকে সবকিছু জানানোর জন্য। আবির বলে-“ভ্যাগিস আমার ফোন নম্বর আপনাদের ট্রাকে ছিল। তা না হলে কী হতো আমার।” এরপর পুলিশের কর্মকর্তা জানতে চান কীভাবে আবির জানতে পারল এই ব্যাপারটি? তখন আবির স্বভাবসুলভ মুচকি হেসে বলল- আসলে সে বিষয়টি জানতে পারেনি, বুঝতে পেরেছিল প্রথমেই যখন তার জানালার চারিদিক থেকে নয়, শুধু এক পাশ দিয়ে ভয়ংকর সব সুরের আওয়াজ পেত। কারণ স্পীকার বক্স এর বিট দেয়াল ঘেষে বাজত। তারপর যেখানে তিন বছর যাবৎ কোন মানুষের চলাচল নেই, সেই ঝরণার কাছে গিয়ে আবির দেখল সেখানে রীতিমত একটা চলার পথ আছে এবং বড় বড় ট্রাকের চলার ছাপও স্পষ্ট। তাই ব্যাপারটা তখন আরও খোলাসা হয়ে গেল । আবার ঘর ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাওয়া আসলেই কিছুই না বরং জানালার কাছে উন্নত প্রজাতির বাজি ফুটিয়ে এই ভৌতিক ব্যাপারটি বানানো হয়। সাথে একটু লাল রঙের আবিরের রঙ ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে ধোঁয়াটা রক্তের রঙের মত লাগে। অন্যদিকে বোটকা গন্ধাটা কেরোসিন তেল আর প্রোপেন গ্যাস মিশিয়ে তৈরী করা। যেটা জুম চায়ের সময়, ফসলকে পোকাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। যা আবির জানত এবং ওই ডায়েরিটায় হুমকি লিখে তারা জানালা দিয়ে আদান-প্রদান করত। এভাবেই আবির বু্দ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতার সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌতিক ঘটনার সমাপ্তি ঘটাল। আর ঝরণা ফিরে পেল আবার তার চিরচেনা রূপ ! এবং ২২২ নং রুমে আবিরের সাথে তার বন্ধুরা একসাথে থাকতে শুরু করল। দিনগুলি দারুনভাবে অতিবাহিত হতে লাগল।
অনন্যা সাহা
শ্রেণি: নবম
আট্টাকা কে আলী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়
ফকিরহাট , বাগেরহাট ।