বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে অধিভুক্তিই কি শিক্ষার মান নিশ্চিত করবে?
ড. মু. ইব্রাহীম খলিলঃ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের গ্র্যাজুয়েটদের মান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে কলেজ পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার মান নিশ্চিত করার নিমিত্তে ঢাকার সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির নির্দেশনা প্রদান করেন। সে মোতাবেক ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে উক্ত কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দেশের প্রায় ৫৮৩টি সরকারি কলেজ জেলা ও বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ উপাচার্যদের সঙ্গে আধুনিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে উপাচার্যগণও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কলেজ পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে এটাই কি সবচেয়ে ভালো সমাধান? এটি বুঝতে হলে আমাদের ধারণা লাভ করতে হবে বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপ কমাতে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করা হয়। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট ৮৮১টি অধিভুক্ত কলেজের মাধ্যমে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার দুই-তৃতীয়াংশ পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৭৩টি সরকারি কলেজে স্নাতক পড়ার সুযোগ রয়েছে। ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে নানা কারণে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। জেলা শহর, এমনকি উপজেলা পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, উপযুক্ত সিলেবাস, শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও গ্রন্থাগারসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে উচ্চশিক্ষা চালু করা হয়েছে। মানা হয় না শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ১ :১৯ হলেও অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ১ :১১৩; কোথাও কোথাও এটি আরো বেশি। যদিও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এই অনুপাত ১:৩০ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় একেবারেই কম। ইউজিসির ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৭০২ টাকা, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ হাজার টাকা। অধিকন্তু সনাতন ধরনের প্রশ্নপত্র ও ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা সম্পন্ন করা গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষার মান অবনয়নের জন্য কম দায়ী নয়। এছাড়া শিক্ষকদের ওপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা সমন্বয় নেই বললেই চলে। শিক্ষকগণ কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সসমূহ পড়ান, পরীক্ষা গ্রহণ করেন ও উত্তরপত্রমূল্যায়ন করেন। তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও অন্য সুযোগ-সুবিধাদি দেখভাল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কলেজগুলোতে ইন-কোর্স পরীক্ষা ও উপস্থিতির নম্বর প্রদান করা হয় ছাত্রনেতাদের চাপ এবং আশপাশের অন্য কলেজে প্রদত্ত নম্বরের সঙ্গে তুলনা করে। একক পরীক্ষক পদ্ধতির কারণে চূড়ান্ত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন হয় না সঠিকভাবে। শিক্ষকগণ যেহেতু ক্যাডারভুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ পান, সে কারণে অন্য ক্যাডারের তুলনায় পদোন্নতি, গ্রেড উন্নয়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা। যার প্রতিফলন ঘটে শিক্ষা কার্যক্রমের নানা পর্যায়ে। ফলে কলেজগুলোর মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তির পরিবর্তে সার্টিফিকেট সর্বস্ব গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। এটি নিয়ে শিক্ষাবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন উদ্বেগ রয়েছে, তেমনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও একই কথা বলছে। ২০২১ সালে বিআইডিএস-এর এক জরিপে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের বদলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ বোঝায় পরিণত হচ্ছে। এই সুযোগে অন্য দেশ অভ্যন্তরীণ উদীয়মান বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। এরকম একটি বাস্তবতায় শুধু ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম হাত বদল হলে গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করবে না। যুগোপযোগী কারিকুলাম, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার সুবিধা, মাথাপিছু ব্যয় বৃদ্ধি এবং ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত মেনে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে। অধিভুক্তি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে গবেষণা করে দেখতে হবে, ঢাকার সাত কলেজে কোন প্রেক্ষিতে, কী ধরনের মানোন্নয়ন ঘটেছে। সাত কলেজের অধিভুক্তিতে কোনো কোনো শিক্ষকের ব্যক্তিগত লাভ হলেও সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কেননা শিক্ষকগণ অধিভুক্ত কলেজ নিয়ে অতিরিক্ত চাপে থাকেন। এ কারণে পাঠদান ও গবেষণায় তাদের অবদান সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে সাত কলেজ অধিভুক্ত হলেও পাঠদান বা গবেষণা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা নেই। বরং বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে হয়েছে কয়েক বার।
প্রকৃতপক্ষে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কলেজগুলোর মাধ্যমে প্রদত্ত সার্টিফিকেট সর্বস্ব উচ্চ শিক্ষা অর্থহীন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া শতবর্ষী কলেজগুলো নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে গেলে একদিকে যেমন উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান কমবে, অন্যদিকে শতবর্ষী কলেজগুলোকে দেখভাল করার পর্যাপ্ত দক্ষতা ও জনবল কোনোটাই নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেই। উপরন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কম বয়সি উপাচার্য ও জুনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে কলেজগুলোর প্রবীণ অধ্যক্ষ ও সিনিয়র শিক্ষকগণ কীভাবে কাজ করবেন, সেটি খুঁজে বের করা দরকার, যেমন :বরিশাল বিভাগে রয়েছে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়—একটি একবারেই নতুন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যটি কিছুটা পুরাতন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ দুটোর কোনোটিই শতবর্ষী ব্রজমোহন কলেজকে তদারকিতে কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। সাত কলেজ ঢাকা সিটিতে অবস্থিত বিধায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তদারকি সম্ভব হলেও বিভাগ বা জেলা পর্যায়ে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে যে কলেজগুলো দেওয়া হবে, তা জেলা সদর বা উপজেলা শহরে অবস্থিত। সেক্ষেত্রে সাত কলেজ মডেলের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
কলেজগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও পর্যালোচনা করা দরকার। ২০১৮ সালের আগে কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (সিইডিপি) শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত অধিভুক্ত কলেজসমূহের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণাগার সংস্কার, উপকরণ প্রদান ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। বর্তমানে সিইডিপি-এর আওতায় শিক্ষণ উপকরণ (কম্পিউটার, স্মার্ট বোর্ড, ল্যাপটপ, ফটোকপিয়ার, মালটিমিডিয়া প্রজেক্টর ইত্যাদি) প্রদান করা হচ্ছে। তবে শিক্ষকস্বল্পতা দূরীকরণ, তাদের যথাসময়ে পদোন্নতি ও গ্রেড প্রদান বিষয়ে শিক্ষকদের হতাশা নিরসনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে প্রশ্ন হলে অধিভুক্তি পরিবর্তন হলেই কি এসব সমস্যার সমাধান হবে? আসলে সেটি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এমনকি বর্তমানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেটিও স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্তির কারণে পাবে না কলেজগুলো; যেমনটি বর্তমানে পাচ্ছে না সাত কলেজ। আবার জেলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে কলেজগুলোর জন্য কোনো তহবিল পাবে, এরকম নজির সাত কলেজের ক্ষেত্রে নেই।
সুতরাং শিক্ষকস্বল্পতা দূর না করে, কারিকুলাম যুগোপযোগী না করে, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন না ঘটিয়ে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না এনে, ভর্তি পরীক্ষা ব্যতীত নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে শুধু অধিভুক্তি পরিবর্তন করে পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, উত্তরপত্র প্রেরণ ও বিতরণ এবং ফলাফল প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কলেজ পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার মানের কোনো পরিবর্তন হবে না। শিক্ষকদের পদোন্নতি, গ্রেড উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কলেজশিক্ষকদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে, সেগুলো নিরসন করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তারা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেলেও মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষা প্রশাসনে কাজ করেন। বাকি ৯৭ শতাংশই শিক্ষক, যারা কলেজ পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত আছেন। তাই তাদেরকে কর্মকর্তার বদলে শিক্ষক হিসেব গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রকাশনা ও উচ্চতর ডিগ্রি জুড়ে দিয়ে সঠিক সময় পরপর প্রতিটি ধাপে পদোন্নতি প্রদান করতে হবে। শূন্য পদ না থাকলেও চাকরির শর্ত পূরণ সাপেক্ষে মূল পদ নিয়ে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি প্রদান করা হলে শিক্ষকদের মধ্যে একদিকে যেমন হতাশা কমবে, অন্যদিকে মেধাবীরা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। মান বাড়বে কলেজ পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষার।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/০৩/২০২৪