কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবসরে গেলেন পোরশা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ!
আল আমিন হোসেন, মৃধা, শিক্ষাবার্তা, ঢাকাঃ নওগাঁর পোরশা সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্য ও কলেজের সম্পত্তি লিজ দিয়ে সেই অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুন মাসে কলেজটির অধ্যক্ষ রেজাউল করিম অবসরে যাওয়ার পর অত্র কলেজের উপাধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও ২০২১ সালের মার্চ মাসে অবসরে যান। তিনি অবসরে যাওয়ার পর মিজানুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব অর্পন করেন। প্রায় দুই বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সালে মিজানুর রহমান অবসরে যান।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, পোরশা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা সাপাহার সরকারি ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয় এবং সাপাহার সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা পোরশা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার জন্য কেন্দ্র ফি বাবদ পোরশা কলেজ সাপাহার কলেজের নিকট থেকে অর্থ পেয়ে থাকেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২০ সালের স্নাতক ১ম বর্ষের ২০২১ জন (প্রতি শিক্ষার্থী ৩০০ টাকা করে) শিক্ষার্থীর কেন্দ্র ফি বাবদ মোট ৬,০৬,৩০০ টাকা, ২০২০ সালের অনার্স ২য় বর্ষের কেন্দ্র ফি ( ১৬৫৬ জন শিক্ষার্থীর ৩০০ টাকা করে) ৫,২৬,৮০০ টাকা, ২০২০ সালের অনার্স ৩য় বর্ষের কেন্দ্র ফি (১৬৫৬ জন শিক্ষার্থীর ৩০০ টাকা করে) ৩,৪০,৫০০ টাকা, ২০২০ সালের অনার্স ৪র্থ বর্ষের কেন্দ্র ফি (৬১৬ জন ৩০০ টাকা করে) ১,৮৪,৮০০ টাকাসহ শুধুমাত্র স্নাতকের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র ফি বাবদ সর্বমোট ষোল লক্ষ আটান্ন হাজার চার শত টাকা সাপাহার কলেজ থেকে কেন্দ্র ফি বাধন উত্তোলন করেছেন। যেটা ব্যাংকে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও ২০২০ সালের ডিগ্রি পাশ ১ম বর্ষের ৩৭,২০০ টাকা, ২০১৯ সালের ডিগ্রি পাশ ৩য় বর্ষের ৫৩,২০০ টাকা (উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সেশনের ৩য় বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালে)। উত্তোলন কৃত অর্থ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান কলেজ ফান্ডে জমা না করে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত উন্মুক্ত পরীক্ষার্থীদের নিকট থেকে প্রতিদিনের প্রতিটি পরীক্ষা ১০০/- করে নকল করানোর সুযোগদানের জন্য আদায় করেছেন। যার পরিমাণ প্রায় সাত লক্ষ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু পরীক্ষার কেন্দ্র ফি'র টাকায় নয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান নিয়োগ বাণিজ্যেও থেমে নেই। কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দানে কয়েক লক্ষ টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। কোন ধরণের নিয়োগ কমিটি ছাড়া একক স্বাক্ষরে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও কলেজের জমির ধান বিক্রয়, আম বাগান অগ্রিম কয়েক সালের জন্য বিক্রয় করেছেন। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের এক টাকাও তিনি ব্যাংকে জমা দেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যেক বছরে স্নাতক ১ম বর্ষের ভর্তি কমিটি গঠন করে এককালীন চার বর্ষের সেমিনার ফি বাবদ প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর নিকট ১৬০০ টাকা করে আদায় করেছেন। যার অর্থ এক টাকাও ব্যাংকে জমা দেননি। ভর্তি কমিটি কর্তৃক আদায়কৃত অর্থ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানসহ কতিপয় শিক্ষক ভাগাভাগি করে খান, যার মধ্যে আছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক তরিকুল ইসলাম।
জানা গেছে, অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ভর্তির যে টাকা ব্যাংক রশিদের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা হতো সেই টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট মিথ্যা ভাউচার উপস্থাপন করে নোট শীটের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। উল্লেখিত বিষয়গুলির হিসাব ব্যাংক স্টেটমেন্ট উত্তোলন করলেই তার সত্যতা মিলবে।
এছাড়াও গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর অরহমান অবসরে যাওয়ার পূর্বে তারই মদদপুষ্ট শিক্ষক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মোদাচ্ছের রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে যান এবং ৫৯ বছর পার হওয়ার পরেও সহকারী অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে ০২ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত অনার্স ২য় বর্ষের পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক করেন। ১৪০০ পরীক্ষার্থীর কেন্দ্র ফির টাকা আত্মসাৎ করার জন্য।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, পরীক্ষার কেন্দ্রের যে ফি তা পরীক্ষা কমিটির দায়িত্ব দেওয়া থাকে। পরীক্ষার কেন্দ্রের খরচ বাবদ এই টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। পরীক্ষার যারা ডিউটিতে ছিল এবং আনুষঙ্গিক খরচ মেলে তার ব্যালেন্স জিরো। তবে এটা ব্যাংকের মাধ্যমে করা উচিত ছিল কিন্তু পরীক্ষা কমিটি সেটা সরাসরি খরচ করে ফেলেছে বলে ব্যাংক হিসাবে দেখানো হয়নি।
নিয়োগ বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে কোন আর্থিক লেনদেন হয়নি। প্রতিষ্ঠানের জমির ধান এবং আম বাগানের অর্থ কলেজ ফান্ডে জমা না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরে রেজুলেশন করে এটা জমা দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ভর্তির যে টাকা ব্যাংক রশিদের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা হতো সেই টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট মিথ্যা ভাউচার উপস্থাপন করে নোট শীটের মাধ্যমে উত্তোলন করার অভিযোগ টিও তিনি অস্বীকার করেন।
জানতে চাইলে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এটিএম শহীদ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কলেজের সকল কার্যক্রম ব্যাংকের মাধ্যমে হবে। পরীক্ষার কেন্দ্র ফি তিনি কেন ব্যাংকে জমা করেননি সেটা আমি বলতে পারব না। আমি সবে মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। প্রতিষ্ঠানে যদি আর্থিক খাতের অডিট হয় সেখানে দায়িত্ব থাকাকালীন আপনাকেই জবাবদিহি করতে হবে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ লুৎফর রহমান শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, বিষয়টি দেখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের কলেজ সেকশন। পরিচালক স্যারেরা যদি এটা নিয়ে আমাদের নির্দেশ দেন তাহলে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারি। মূলত আমরা মাধ্যমিক স্তরটাই দেখি।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক মোঃ আব্দুল খালেক সরকার শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ হয়েছে। এখন তারা এমপিওর অংশ ভোগ করে না। এটা আসলে দেখভাল করার দায়িত্ব মাউশি ডিজি মহোদয়ের। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে মাউশিতে অভিযোগ দায়ের করেন তাহলে ডিজি মহোদয় নির্দেশ দিলে তখন তদন্ত হয় এবং এরপর তদন্তের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়