ডিমলায় গোপনে দাতা সদস্য নেওয়ার পাঁয়তারা প্রধান শিক্ষকের
নিজস্ব প্রতিবেদক, নীলফামারীঃ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য গঠিত এডহক কমিটি কর্তৃক দাতা সদস্য নিয়োগ দানের কোন সুযোগ না থাকলেও জেলার ডিমলার ডালিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে একবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাতা সদস্য আহ্বান করে এবং একবার গোপনে দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য ব্যাংক মারফত টাকা জমা নিয়েছেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি দুইজন খন্ডকালীন দাতা সদস্য নিয়োগ দানের জন্য অতি গোপনে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া দুইব্যক্তির নিকট থেকে দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য ব্যাংক মারফত টাকা জমা নিয়েছেন ডালিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সহিদা ইয়াসমিন ।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এডহক কমিটির অনুমোদন দেয় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড। এর একদিন পরেই গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে রুপালী ব্যাংকে ডালিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একাউন্টে দুই জন খন্ডকালীন দাতা সদস্য নিয়োগ দানের জন্য ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা জমা নিয়েছেন। আর এই দুইজন খণ্ডকালীন দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য রেজুলেশন করার লক্ষে বিদ্যালয়টির অভিভাবক প্রতিনিধি রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে তাকে না বলে ০৪ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে স্বাক্ষর নেন এডহক সভাপতি মঈনুল হক এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। স্বাক্ষর নেওয়ার পরে আরও দুইজন দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য স্বাক্ষর নেওয়া হলো বলে তাকে (অভিভাবক প্রতিনিধি) জানান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শহিদা ইয়াসমিন।
এর আগে গত বছরের ২০ আগস্ট দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (তখনও বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এডহক কমিটি ছিল)। বিজ্ঞপ্তিতে আজীবন দাতা সদস্য হতে দুই লক্ষ টাকা এবং খণ্ডকালীন দাতা সদস্য হতে ২০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বিজ্ঞপ্তি দেখে ৯ জন আগ্রহী ব্যক্তি খন্ডকালীন দাতা সদস্য হতে বিদ্যালয়টির ব্যাংক একাউন্টে ২০ হাজার করে টাকা জমা দেন। তবে ব্যাংকে টাকা জমা দিলেও দাতা সদস্য প্রার্থী হিসেবে অদ্যাবধি তাদের দাতা প্রার্থীতা ঘোষণা করা হয়নি।
নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি ছাড়া কোন বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোন ধরণের দাতা সদস্য নিয়োগদানের এখতিয়ার নেই। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির প্রবিধানমালা ২০০৯ এর ধারা '২' এর উপধারা 'চ' এ দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য বলা আছে, 'ঢাকা মহানগর এলাকায় অবস্থিত মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান গভর্ণিং বডির বা, ক্ষেত্রমত, ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণের অন্ততঃ ১৮০ দিন পূর্বে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নগদ অথবা চেকের মাধ্যমে এককালীন দুই লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন; এবং ঢাকা মহানগর ব্যতীত অন্য এলাকায় অবস্থিত মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান গভর্ণিং বডির বা, ক্ষেত্রমত, ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণের অন্ততঃ ১৮০ দিন পূর্বে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নগদ অথবা চেকের মাধ্যমে এককালীন ২০,০০০.০০ (বিশ হাজার) টাকা দান করিয়াছেন।'
অর্থ্যাৎ নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হবার ১৮০ দিন পূর্বে দাতা সদস্য নিয়োগ দিতে পারবেন। অন্যদিকে এডহক কমিটির মেয়াদ থাকে ১৮০ দিন। এক্ষেত্রে এডহক কমিটি কোন দাতা সদস্য নিয়োগ দিতে পারেন না। শুধু মাত্র দাতা সদস্য নয় এডহক কমিটি কোন ধরনের নিয়োগ দিতে পারেন না মর্মে ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা ২০০৯ এ সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।
না বলে স্বাক্ষর নেওয়া বিদ্যালয়টির অভিভাবক সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে স্বাক্ষর চাইলেন আমি স্বাক্ষর দিলাম। স্বাক্ষর দেওয়ার পরে তারা (সভাপতি-প্রধান শিক্ষক) জানালেন নতুন দুই জন দাতা সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পূর্বের তারিখের রেজুলেশন করার জন্য আপনার স্বাক্ষর নিলাম। এ সময় প্রধান শিক্ষক বলেন বিষয়টি কাউকে না জানাতে এটা গোপন থাকবে।
স্বাক্ষর নেওয়া প্রসঙ্গে এবং এডহক কমিটি দাতা সদস্য নিয়োগ দিতে পারেন কি না জানতে চেয়ে ডালিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির (এডহক) সভাপতি মঈনুল ইসলাম শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, ১৮০ দিন পূর্বে দাতা সদস্য সংগ্রহের বিধান আছে। এটা নিয়ে এত ভালো বুঝি না। তাই বিজ্ঞ কয়েকজন প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করেছি। দুই জন দাতা সদস্যের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল ০৯ ফেরুয়ারি ২০২৩ তারিখে। তবে এটা ভালো বলতে পারবেন প্রধান শিক্ষক উনি দিয়েছিলেন বিজ্ঞপ্তি। আপনার কমিটির অনুমোদন হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তাহলে ০২ ফেব্রুয়ারি কিভাবে দাতা সদস্য আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা প্রধান শিক্ষক বলতে পারবেন ভালো করে।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সহিদা ইয়াসমিন বলেন, দুই জন দাতা সদস্য নেওয়া হয়েছে বিধিমোতাবেক। কোন বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কিভাবে বিধিমোতাবেক হয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কোন কিছু হয় ? দুইজন দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য অভিভাবক সদস্যের কাছ থেকে যে স্বাক্ষর নিলেন তা তিনি জানেন না। স্বাক্ষর নেওয়ার পরে বলেছেন, দাতা সদস্য নিয়োগের জন্য নেওয়া হলো, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পরিস্থিতি যেমন ছিল তেমন। এডহক কমিটি দাতা সদস্য নিয়োগ দিতে পারে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এডহক কমিটি কেন পারবে না। নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে বলে ফোন কেটে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের স্বামী ডালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান ফোন করেন, তিনি কেন সংবাদ করছি। আমাদের এত ইন্টারেস্ট কিসের বলে গালমন্দ করতে থাকেন এবং বলেন, এই স্কুল নিয়ে আমরা কি করতে পারব আমাদের কি ক্ষমতা আছে। প্রত্যুত্তরে, যেখানে অনিয়ম হয় সেটাই গণমাধ্যম তুলে ধরে এর বাহিরে কিছু না। এর পর তিনি বাজে ব্যবহার করে লাইনটা কেটে দেন।
জানতে চাইলে ডিমলা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল হালিমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এডহক কমিটি কোন কমিটিই না। এটা দেওয়া হয় শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজন করার জন্য। এর বাইরে রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন তারা কোন নিয়োগ দিতে পারে না। তবুও যেখানে দিনের পর দিন এডহক কমিটি চলছে আমরা সেখানে নিয়মিত কমিটি গঠনের নির্বাচনে দাতা সদস্য সংগ্রহের জন্য যে দিন এডহক কমিটি গঠন হয় ঐ দিনই বিজ্ঞপ্তি দিতে বলি। এর বাইরে কোন সুযোগ নেই। তবে ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধিমালা ২০২৩ যেটা অনুমোদনের অপেক্ষায় সেখানে এই বিষয় নিয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। আইনটি পাস হলে আরও ক্লিয়ার হওয়া যাবে।
তবে এ বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্ত শিক্ষা বোর্ডের আহ্বায়ক অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এডহক কমিটির কোন ধরণের নিয়োগের সুযোগ নেই। আর দাতা সদস্য আহ্বান করতে পারে শুধু মাত্র নিয়মিত কমিটি। কারণ প্রবিধানে বলা আছে নির্বাচনের ১৮০ দিন পূর্বে দাতা সদস্য নেওয়া যাবে সেখানে এডহক কমিটির মেয়াদই থাকে ১৮০ দিন তাহলে তারা কিভাবে পারবেন। এডহক কমিটি দাতা সদস্য নিলে তা প্রবিধানমালা লঙ্ঘন হবে।
সংশ্লিষ্ট খবরঃ
- ডালিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়: এডহক কমিটিতেই চলছে বছরের পর বছর
- ডিমলায় জাল সনদে শিক্ষক বিশ্ব নাথের বিশ্ব জালিয়াতি
- নিয়োগ ও সনদ জালিয়াতি করে শিক্ষক বিশ্ব নাথের ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা
- নিয়োগ ও সনদ জালিয়াতি করেও স্বপদে বহাল শিক্ষক বিশ্বনাথ
- ফেঁসে যাচ্ছেন এমপিওভুক্ত ৮১৪ শিক্ষক, আমলনামা মন্ত্রণালয়ে
- ডিমলায় ৯ম স্কেলে ৫ বছর ধরে সহকারী প্রধান শিক্ষক, নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়