জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা পেতে এসএসসি সনদবিহীনরা পড়ছেন বিপাকে

অনলাইন ডেস্ক :

জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা পেতে সীমাহীন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। বিশেষ করে যাদের এসএসসি পাসের সনদ নেই তারা পড়ছেন চরম বিপাকে। তবে ওপর মহলে যোগাযোগ ও আর্থিক লেনদেনে কেউ কেউ হয়রানি থেকে পার পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার পর থেকে এখনো পর্যন্ত নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথমদিকে দেওয়া অনেক তথ্যই এখন পুরাতন হয়ে গেছে, যা প্রতিনিয়ত সংশোধনে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে নাগরিকদের। এছাড়া স্মার্টকার্ড গ্রহণ করা নিয়েও বিড়ম্বনায় পড়ছেন অনেকেই।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের পাকুন্ডা পূর্বপাড়ার (বালীয়া) বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন ভুঁইয়া। এনআইডি পেয়েছেন তিনি, কিন্তু বর্তমান ইসি বলছে তিনি ভোটার নন। ২০০৮ সালের ৪ জুন লেমিনেটিং করা এনআইডি (যার নম্বর-৬৭১০৪৩৪১১৪৩২৬) পেয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি সোনারগাঁও এলাকায় স্মার্টকার্ড বিতরণের সময় কার্ড বঞ্চিত হন তিনি। স্থানীয় নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়, ‘নন ফাউন্ড’ অর্থাত্ আপনার স্মার্টকার্ডটি প্রিন্ট হয়নি। দিনের পর দিন নির্বাচন অফিসে ধরনা দিয়েও কার্ড পাননি তিনি। পরবর্তীতে ঢাকার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে চলে আসেন তিনি। জানতে পারেন, ইসির ডাটাবেজে তাঁর কোনো তথ্য নেই অর্থাত্ তিনি ভোটার নন। এনআইডি থেকে তাকে নতুন করে ভোটার হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। নির্বাচন ভবনে গত রবিবার এ প্রতিবেদককে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনটি জাতীয় নির্বাচনে এবং বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে তিনি ভোট দিয়েছেন। কিন্তু ইসি থেকে এখন বলা হচ্ছে তিনি ভোটার নন। এটি কীভাবে সম্ভব? একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই ধরনের দায়িত্বহীন আচরণ মানা যায় না। শুধু মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন ভুঁইয়া নন— এমন হাজার হাজার নাগরিক এনআইডি সেবার নামে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

ভোগান্তি দূর করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির সেবা কার্যক্রম। ভোটার জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন এবং নতুন কার্ড মুদ্রণে মাঠের উপজেলা অফিস, জেলা অফিস, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগের (এনআইডি) কার কী ক্ষমতা তা-ও নির্ধারিত করা হয় প্রজ্ঞাপনে। তারপরও বিড়ম্বনা কমছেই না।

ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর থেকে দেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ভোটারকে লেমিনেটিং কার্ড দেওয়ার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান শুরু হয়। বর্তমানে দেশে ভোটার সাড়ে ১০ কোটি। এই ভোটারদের কমপক্ষে অর্ধেক বা ৫ কোটির মতো অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত, কোনো সনদধারী নন। এ অশিক্ষিত ভোটারদের এনআইডিতে কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে সংশোধনে চরম বিপাকে পড়তে হয়। কেননা সাধারণ নিয়মানুযায়ী প্রতিটি এনআইডি সংশোধন আবেদন সংশ্লিষ্ট স্থানীয় নির্বাচন অফিসের মাধ্যমে করতে হয়। সংশোধনের কাজটি সম্পন্ন করা হয় ঢাকা থেকে। কোনো ধরনের তদবির বা যোগাযোগ না থাকলে বছরের পর বছর সেই আবেদন পড়ে থাকে। ফলে সেবা পাওয়া তো দূরের কথা সংশোধনের সঙ্গে সংযুক্ত মূল এনআইডিও ফেরত পান না ভুক্তভোগীরা।

যশোরের ঝিকরগাছার কলাগাছি গ্রামের মো. নাজমুল হোসেনের জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম এসেছে শুধু এক শব্দে ‘নাজমুল’ (জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর-৪১১২৩৫৯৯০০২৬৮)। কিন্তু এক শব্দে নাজমুল নামের কারণে তিনি বিদেশের ভিসা পাচ্ছেন না। নাজমুল তার নাম সংশোধনের জন্য স্থানীয় নির্বাচন অফিসে বছর দেড়েক আগে যোগাযোগ করেন। উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে বলা হয়, এসএসসির সনদ না থাকায় তার নাম সংশোধন সম্ভব নয়। তাকে ঢাকার আগারগাঁও নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে নাজমুল  বলেন, ‘শুধু আমার একা নয়, আমার মা, বোন এবং ভাইদেরও নাম ভুলভাবে এন্ট্রি করেন। আমার মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম কিন্তু এনআইডিতে এন্ট্রি করা হয়েছে ‘পাতা’ নামে। যিনি এন্ট্রি (মাঠকর্মী) করেছিলেন তিনিই এজন্য দায়ী। তাহলে সারাজীবন কেন আমাকে সেই ভুলের দায়ভার বহন করতে হবে ?’

জানা গেছে, ভোটার তালিকা হালনাগাদে প্রতিবারই তথ্য সংগ্রহের সময় উভয় পক্ষের গাফিলতির কারণে তথ্যের গরমিল থাকছে। এসব ক্ষেত্রে নামের বানান, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, পিতা-মাতার নামের বানান নির্ভুল করা যায়নি। মাঠপর্যায়ের অনিয়ম পর্যবেক্ষণ করে ভোটার তথ্য সংগ্রহ ফরমে পিতা-মাতার নাম ও বর্তমান ঠিকানা ভুল করা এবং আইডি নম্বরের ঘর খালি রাখা, শনাক্তকারীর স্বাক্ষর না থাকা, সুপারভাইজার ও যাচাইকারীর নাম ও স্বাক্ষর না থাকা, এইচএসসি পাস হওয়া সত্ত্বেও স্বাক্ষর না নিয়ে শুধু টিপসই নেওয়া, আঙ্গুলের অস্পষ্ট ছাপ, ইংরেজি ও বাংলা বানানে অসামঞ্জস্যসহ ২১টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। দায়ী মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এসব বিড়ম্বনার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘প্রত্যেক নাগরিককে সঠিক সেবা দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। এখন বিড়ম্বনা নাই। সনদ না থাকলে যাচাই-বাছাই করে সংশোধন করা হয়। কোনো নাগরিক যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন সে জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।’