শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দিনভর ক্লাস-পরীক্ষার ধকল, খরচ মেটাতে আছে টিউশনি কিংবা পার্টটাইম জব। পাশাপাশি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কাটে নির্ঘুম রাত। উচ্চশিক্ষারত প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই এমন কঠোর পরিশ্রমের জীবনযাপন করতে হলেও চরমভাবে উপেক্ষিত তাদের পুষ্টির বিষয়টি।
হল ক্যান্টিনের নিম্নমানের খাবারে পুষ্টিচাহিদার ন্যূনতম পূরণ না হলেও এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নেই কোনো মাথাব্যথা। এমন উদাসীনতার দায়ভার একদিন পুরো জাতিকে বহন করতে হবে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ এই সময়ে শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সংশ্লিষ্টদের হতে হবে আরও মনোযোগী।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্দীন হলে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় আবাসিক শিক্ষার্থী আব্দুল মমিনের। ক্লাস শেষ করে আড়াইটার দিকে হল ক্যান্টিনে খাবার নিয়ে বসেন তিনি। পাঁচ থেকে ছয় পদের তরকারি থাকলেও দুপুরের খাবারের জন্য তার পছন্দ লাউ-চিংড়ি। মাঝপথে জানতে চাওয়া–পছন্দের খাবারটি কতটা তৃপ্তি মেটালো তার?
মমিন বলেন, ‘এই খাবারটা শুধু আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই খেতে হচ্ছে। এই খাবার আমাদের শারীরিক কিংবা মানসিক বিকাশের জন্য মোটেও উপযোগী নয়।’
এরপর পাশের টেবিলে গিয়ে জানা গেল, বিজয় একাত্তর হলের সালাহউদ্দিন আহমেদ খাচ্ছেন বন্ধু রাসেলকে নিয়ে। দুই বন্ধুর একজন মুরগির মাংস এবং অন্যজন খাচ্ছেন লাউ-চিংড়ি। আনলিমিটেড ভাত ও ডালের সঙ্গে মুরগির জন্য গুনতে হবে ৫৫ ও লাউ-চিংড়ির জন্য ৩৫ টাকা।
তারা বলেন, ‘খাবারের জন্য একেকদিন একেক হলে যাই। মূলত মানসম্মত খাবার কোনো হলেই পাওয়া যায় না। লাউ-চিংড়ির দিকে তাকালে চিংড়ি তো দেখাই যায় না। দেখলেও মনে হয়, মাত্রই বোধ হয় চিংড়িটি জন্মেছে। লাউটাও বেশ শক্ত।’
আব্দুল মমিন, সালাহউদ্দিন কিংবা রাসেলই নন, হল ক্যান্টিনে খেতে আসা প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতাই তিক্ত। বছরের পর বছর খাবার নিয়ে এমন উদাসীনতা আর অবহেলা চলে এলেও কারো নেই কোনো মাথাব্যথা।
ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘এক কেজি মুরগি ১৬ টুকরা করতে হয়। মুরগির যে দাম, তাতে এ ছাড়া উপায়ও নেই। তবে শিক্ষার্থীরা খাবার নিয়ে সন্তুষ্ট আছে।’
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘খাবারের মান মোটেও ভালো নয়। সম্প্রতি পচা মাংসও খেতে হয়েছে। এ ছাড়া ভাতে সরাসরি পোকা দেখা যায়। আর ডাল ও পানির মধ্যে তো পার্থক্য বোঝাই যায় না। অনেকে পানি মনে করে সেখানে হাতও ধুয়ে ফেলে। বাধ্য হয়েই আমাদের মানহীন এসব খাবার খেতে হচ্ছে।’
এমন পরিস্থিতিতে ক্যান্টিন ছেড়ে অনেকেই বাধ্য হন বাইরের দোকানে খেতে। দুই বন্ধু সঞ্জয় পাল ও মহিউদ্দিনের অবস্থা তেমনই। সকালে হল ক্যান্টিনে নাশতার ব্যবস্থা থাকলেও বাইরে খেতে যান। কিন্তু কেন?
তারা বলেন, ‘রুটি দেখলে তো মনে হয় টিস্যু পেপার খাচ্ছি। যে খাবারটা খাই, সেটা থেকে পর্যাপ্ত ক্যালরি পাই না। তাই বাধ্য হয়ে হলের খাবার খেয়েও বাহিরে খেতে হচ্ছে। এতে কিন্তু আমার খরচও বেড়ে যাচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা তাদের খাওয়ার খরচ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করে থাকে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই এই পুষ্টির বিষয়ে খুব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এটি আমার কাছে খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় যদি শিক্ষার্থীদের পুরো দায়িত্ব নিতে পারতাম, তবে সেটা হতো সবচেয়ে আনন্দের। কিন্তু নানান ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে।’
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘যখন আমরা মন ও মেধা দিয়ে কাজ করি, তখন পুষ্টির আরও বেশি দরকার হয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ে যারা আবাসিক শিক্ষার্থী আছেন, তাদের জন্য খুবই দরকার। বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মানটা ঠিক থাকছে কি না, সেটির বিষয়ে আমরা নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছি। এ ব্যাপারে পেপার ওয়ার্ক চলছে।’
পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসমিন বলেন, ‘তার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, সে ততটুকু প্রোটিন, আমিষ, ভিটামিন ও মিনারেলস শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য খাবার থেকে থেকে পাচ্ছে কি না, সেই বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।’
তথ্য বলছে, দুপুরের খাবারের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনগুলোতে সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ টাকা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ টাকা গুনতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে নেই কোনো ভর্তুকি। বাজেট কমের অজুহাত প্রতিটি প্রশাসনের। এ ছাড়া ক্যান্টিনের খাবারের মান নেমে যাওয়ার পেছনে ক্ষমতাশীল ছাত্র সংগঠনেরও দায় আছে বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়