কাকন রেজা।।
আমাজনের আগুন আর জামালপুরে সদ্য ওএসডি হওয়া জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরের ঘটনার ধারাবাহিকতায় কিছু মিল রয়েছে। মিলটা হলো, নিজের ঘর ছেড়ে পরের ঘরে উঁকি মারার বিষয়টিতে। কী পরিমান সার্চ হয়েছে গুগলে জেলা প্রশাসকের সাহেবের ‘সেক্স স্ক্যান্ডালে’র ব্যাপারে তার খোঁজ অনেকেই জানিয়েছেন। যেমনটা হয়েছিল মিন্নির ব্যাপারে।
মিন্নির ‘স্ক্যান্ডালে’র সার্চ ছাপিয়ে গিয়েছিলো মূল খবরকে। এমনটা হয়েছে জামালপুরের সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসকের ক্ষেত্রেও।
প্রথমে আমাজনের কথা বলি। আমাজন পৃথিবীর ফুসফুস, এখন এটা সবার মুখস্ত হয়ে গেছে। সেখান থেকে সারা পৃথিবীর বিশ ভাগ অক্সিজেনের জোগান আসে তাও জানা। দাবানলে আমাজন পুড়ছে এটাও জানে সবাই। তবে আমাজনের আগুন নতুন নয়, ফি বছরই লাগে। এবারের পরিমানটা বেশি। হয়তো সে কারণেই আমাদের দেশেও সেই আগুনের আঁচটা লেগেছে। ফি বছর না হলেও এবার আমাদের কতিপয় বুদ্ধিজীবী রীতিমত খেপে উঠেছেন। তুমুল পরিবেশ-প্রতিবেশবাদী হয়ে উঠেছেন। তবে মুশকিল হলো, যে দেশে উগ্রপন্থীরা ক্ষমতায় থাকেন সেখানেই আগুন লাগে, সেটা বনেই হোক, সমাজ বা রাষ্ট্রেই হোক। উগ্রপন্থী মানে শুধু দলীয় ভাবে নয়, ব্যক্তি চিন্তাও উগ্রপন্থার কারণ হতে পারে।
খেয়াল করলে দেখবেন, এক শ্রেনির ‘বুদ্ধিজীবী’ আছেন, যারা বিশ্বের তাবত সমস্যার সমাধান করে ফেলতে চান। ফেলতে চাওয়ার কারণও রয়েছে। সোজা কথায় বলতে গেলে ‘ডাইভার্শন’ সৃষ্টি। মূল ‘ফোকাস’টাকে সরিয়ে দেয়া। আর এটা হয় আভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত দেশে। যেখানে ‘আউট অব ফোকাস’টা বড় দরকারি। যে দেশে সমস্যা যত বেশি, সে দেশের কিছু ‘বুদ্ধিজীবী’র বাইরের সমস্যা নিয়ে আলাপ তত বেশি। সেই আলাপের যন্ত্রণায় গণমাধ্যম আভ্যন্তরীণ থেকে আন্তর্জাতিক হয়ে যায়। অর্থাৎ উপ সম্পাদকীয়ের জায়গায় দেশিয় আলাপ কোনঠাসা হয়ে পড়ে। বিপন্ন সুন্দরবন কোনঠাসা হয় আমাজনের দাবানলে।
সুন্দরবন নিয়ে কি হচ্ছে তা প্রায় সবারই জানা। কিন্তু সুন্দরবনের ব্যাপারে মৌসুমি কথামালা ছাড়া খুব বেশি কিছু একটা হয়নি। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদরা তাদের আন্দোলনে ব্যাপক সম্পৃক্ততা আনতে পারেননি। এর কারণ হলো- যারা কথা বলবেন, তাদের বড় একটা অংশের নিরবতা। যে অংশের অনেকে এখন আমাজন নিয়ে সরব। এটাই হলো, নিজের ঘর ছেড়ে পরের ঘরের দিকে নজর দেয়ার নজির। তবে আনু মুহাম্মদদের ব্যর্থতার আরো কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো, মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থতা। ব্যর্থতার এই আলোচনাটি অনেক বড় এবং গূঢ়। যা এই লেখাতে আপাত সম্ভব নয়।
যাক গে, আমাজনের সাথে জামালপুরের সদ্য সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের দৃশ্যচিত্রের মিলটার কথা বলি এখন। আমার একটি লেখা ছিল ডিসি সাহেবের বিষয়ে। সেই লেখাতে কতগুলো প্রশ্ন ছিলো আমার। মূল প্রশ্ন ছিলো, যাদের অন্যায়ের কারণে একটি রাষ্ট্রের বুনিয়াদই নষ্ট হতে বসে, সে ব্যাপারে কথা না বলে, আমরা বলছি যৌনতা নিয়ে! যা আবার হয়েছে উভয়ের সম্মতিতে। কথাবার্তায় ‘ফেমিনিস্ট’ দাবি করা কেউ কেউ এতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, এখানে ডিসি সাহেব ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই নারীকে ‘ইয়ে’ করেছেন। তিনি হয়তো, আরো অনেক নারীকে তার ‘ইয়ে’র শিকার করেছেন ইত্যাদি-ইত্যাদি। সাথে আমার চিন্তার পশ্চাৎপদতা নিয়েও আফসোস ছিলো। চিন্তার এমন প্রকাশকে স্বাগত জানিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, যৌনতাই কি মূল সমস্যা, অন্যসব কি অপ্রয়োজনীয়? একটা রাষ্ট্রকে কিভাবে ‘রিপাবলিক’ হয়ে উঠতে হয়, তার জন্য কি কি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, তাকি জানা আছে এমন মানুষদের! থাকলে ‘রিপাবলিক’ না হয়ে উঠতে পারার ব্যাপারগুলো তাদের বোধে থাকার কথা।
একজন গণমাধ্যমকর্মী লিখলেন, ‘প্রতি অফিসে ঘরে যদি সিসি থাকতো, তবে অনেকেরই এমন ছিঃ ছিঃ শুনতে হতো।’ কথাটা মিথ্যা নয়। আমরা কেউই যৌনতার বাইরে নই। অনেকে সুযোগের অভাবে চরিত্রবান। সত্যিকার চরিত্রবানের সংখ্যা ভীষণ রকম কম। ব্রহ্মচারীদেরও বিভ্রম ঘটে। মেনকার নাচ ঋষিদের ধ্যান ভাঙায়। সুতরাং, যৌনতা বাদে ওই জেলা প্রশাসক সাহেব দাপ্তরিক যেসব অন্যায় করেছেন তা ধর্তব্যে আনা হলো ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো অনেক, যা জেলা ও জেলাবাসীর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। সেগুলো নিয়ে কিন্তু এত কথা হয়নি। গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম, ‘ডিসি জামালপুর’ ইংরেজিতে এবং ‘জেলা প্রশাসক জামালপুর’ বাংলায়, দেখেছি তার যৌনতায় গুগল সয়লাব, দুর্নীতি খুঁজে পাইনি। হয়তো আছে, কিন্তু যৌনতার প্রাবল্যে সব ঢাকা পড়ে গেছে। আহা, এই প্রাবল্য যদি দুর্নীতি প্রতিরোধে থাকতো!
জেলা প্রশাসকের যৌনতার ভিডিওটি চার মিনিটের না চব্বিশ মিনিটের তা নিয়ে যে পরিমান বিতর্ক দেখেছি, জেলা প্রশাসক কত কোটি টাকা কোন প্রকল্পে থেকে লোপাট করেছেন, নিয়োগ বাণিজ্যে কত টাকা হাপিস করেছেন, সেই বিতর্ক কিংবা আলোচনা কিন্তু দেখিনি তেমন কোথাও! অথচ ওই ডিডিও’র পরিমাপ না করে, দুর্নীতির খতিয়ান পরিমাপ করাটা ছিলো জরুরি। ওই যে, আমরা জরুরি কাজটা রেখে পরের ঘরে উঁকি দিই। সুন্দরবন ছেড়ে আমাজনের জন্য আহাজারি করি!
আমরা যে জরুরি কাজটা করি না, তা আরেকটা খবরই জানান দেয়। রিফাত হত্যাকাণ্ড আর মিন্নির বিষয় নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যম খবর করেছে, ‘এজাহারভুক্ত আসামিদের খোঁজ নেই, মিন্নিকে নিয়ে ব্যস্ত’, অনেকটা এমন শিরোনামে। রিফাত হত্যাকান্ডে এজাহারভুক্ত চার আসামি ধরা পড়েনি। সিসি’র ফুটেজে আরো কয়েকজন জড়িত থাকার প্রমান রয়েছে, তারাও আইনের আওতার বাইরে, এমন কথাই বলছে গণমাধ্যমগুলো। অথচ সবাই ব্যস্ত মিন্নিকে নিয়ে। অবশ্য গণমাধ্যমও এর বাইরে নয়। গণমাধ্যমে দেখলাম, কারাগারে মিন্নি বই পড়ে সময় কাটাচ্ছেন, এমন খবর। মিন্নি কারগারে বই পড়ছে না রান্নাবাড়া করছে তারচেয়ে বেশি জরুরি, কেনো এজাহারভুক্ত চারজন গ্রেপ্তার হচ্ছে না, বাকিরা কেনো এখনো আইনের আওতামুক্ত, এমন আলাপ।
উপরের আলোচনায় কি মনে হলো, আমরা জরুরিটা করি! যে কারণেই হোক প্রায়োরিটি নির্ধারণে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভয়াবহ রকম ব্যর্থ। আর এই ব্যর্থতার ফাঁক গলে শেয়ার বাজার লুট হয়ে যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা হাপিস হয়। মশা মারার বাতিল ঔষধ কেনা হয়, ঘটে বালিশকান্ড। অযোগ্যরা বসে যায় যোগ্য জায়গায়। একটা রাষ্ট্রের ‘রিপাবলিক’ হয়ে উঠার ব্যর্থতা লুকিয়ে থাকে এই প্রায়োরিটি নির্ধারণের মধ্যেই। আর এই বিষয়টি অন্যের যৌনতার খবরে আনন্দ লোটা, আমাজনের আগুনে বিদগ্ধ হবার মতন মানুষদের বোধে সম্ভবত নেই। থাকলে ভালো হতো। থাকলে, কোনা প্রশাসকই হয়তো দুর্নীতিসহ কোনো অপকর্মেই সাহস করে উঠতেন না। সাথে আমাজনের চেয়ে সুন্দরবন নিয়ে আলোচনা হতো বেশি। এমনটা যে কেনো হয় না!
কলাম লেখক ও সাংবাদিক।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.