মোঃ আঃ বাতেন ফারুকী।।
২২ জুলাই ২০১৯ তারিখের যুগান্তর পত্রিকার ডেস্ক রিপোর্ট অনুসারে বিগত কয়েক দিনের(প্রতিবেদনে দিনের সংখ্যা উল্লেখ নেই,সম্ভবত শনি ও রবিবার – এই দুই দিনের ঘটনা) ব্যবধানে বাংলাদেশে ছেলে ধরা সন্দেহে ১৩ জেলায় ২৬ জন গণপিটুনির শিকারে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে গণপিটুনি বিষয়টি ইদানিং টক অব দ্য কানট্রিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনটি পুরোপুরি পড়েছি। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, উক্ত প্রতিবেদনটিতে নওগাঁর ৬ জন জেলে ও কুমিল্লার ৩ জন বাদ দিলে বাকি ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনই সরাসরি মানসিক প্রতিবন্ধী। একই দিনের যুগান্তরের পাশাপাশি অন্য একটি প্রতিবেদনে সর্বাধিক প্রচারিত তাসলিমা বেগম রেনু হত্যাসহ আরও দুইজন গণপিটুনির শিকার হন এবং আরও একজন নিহত হন ।
এক্ষেত্রে তিনজনই মানসিক প্রতিবন্ধী। যুগান্তরের উল্লেখিত দুটো প্রতিবেদন কোন রকম বিশ্লেষণ ছাড়াই মোটা দাগে বলে দেয়া যায় যে, তথাকথিত ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি বা গণধুলাই নামে যে হত্যাকান্ড ও নারকীয় তান্ডব চলছে তা বিকৃত মানসিকতা বা বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়।আর এর শিকার হচ্ছে এদেশের সবচেয়ে চরমভাবে অবহেলিত ও নিগৃহীত মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিবর্গ।
পরিবার,সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কোনটাই তাদের জন্য এগিয়ে আসে না।যে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে সে পরিবার হয়তো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। তাও পরিবারটিকে আবার ঝাড়-ফোঁক বা কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে। আর অস্বচ্ছল পরিবার হলেতো কথাই নেই।এক্ষেত্রে মানসিক রোগীটি অবহেলা, অযত্নে ও বৈরী আচরণে এক পর্যায়ে রাস্তায় ভবঘুরে জীবন যাপন করতে থাকে। সমাজে কেবল এরাই মানসিক রোগী বা পাগল বলে পরিচিত।এদের সংখ্যা যেমনই হোক আছে।
কিন্তু এর বাইরে যারা আছে তাদের সংখ্যা ভয়ংকর রকমের। সাংখ্যিক ধারণা দেয়ার আগে বলে রাখা প্রয়োজন আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত আত্মসমালোচনা করতে অভ্যস্ত নয়। আর নিজের কোন সমস্যা আছে সেটা মানতে তো একেবারেই নারাজ। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে বাংলাদেশে কমপক্ষে এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ সরাসরি বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ এদেশের প্রতি ১৩/১৪ জন লোকের মধ্যে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত। ইহা নিশ্চিতভাবে জাতির জন্য অশনি সংকেত। তবে সেভিয়ার পর্যায়ের অর্থাৎ যারা কিনা একেবারে ভারসাম্যহীন তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়, এক শতাংশেরও নিচে হবে।
এ শ্রেণির রোগীদের চিনতে কারো পক্ষে সমস্যা হয় না। সমস্যা হলো বাকি বিশাল সংখ্যার রোগীদের নিয়ে যারা মূল স্রোতের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে আছে। এদের মধ্যে একটি অংশ আছে যারা খুব কষ্ট করে, নিজের উপর চাপ প্রয়োগ করে নিজেকে কোনো রকমে সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন যা কিনা সমাজের খুব কম লোকেই বুঝতে পারেন বা উপলব্ধি করতে পারেন। এরা আবার বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হয় না।কারণ চিকিৎসা নিতে গেলেই সমাজে তারা মানসিক রোগী বা পাগল বলে চিহ্নিত হবে। এরা প্রতিবাদী বা অনিচ্ছুক প্রতিবন্ধী।
এরাই মাঝে মধ্যে ভারসাম্য হারিয়ে এমন কিছু আচরণ করে ফেলে যা তাদেরকে সমাজের আরেক শ্রেণির মৃদু প্রতিবন্ধীদের কাছে ছেলে ধরা হিসেবে প্রতীয়মান করে। ফলে অনিচ্ছুক প্রতিবন্ধীরা সমাজে প্রতিনিয়ত মৃদু প্রতিবন্ধীদের হাতে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। গণপিটুনি আমাদের দেশে নূতন কিছু নয় বরং ইহা একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। বর্তমানে হয়তো বা পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট গুজবের কারণে মাত্রাতিরিক্ত চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বিশ্ব তথা ডিজিটাল বাংলাদেশে এমন ডাহা ‘মিথ্যা’- গুজব হিসেবে আমাদের চোখের সামনে দাপটে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমরা সবাই কি সহনশীল মনোভাব নিয়ে সর্বংসহার মতো সবকিছুই সহ্য করে যাচ্ছি।
এমন কেন হচ্ছে? এর উত্তর খোঁজার জন্য সমাজকে নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এবং সরকারের উচিত সমাজবিজ্ঞানী কিংবা মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ মতো জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থ গ্রহণ করা। একটা লোক একটি পরিবারে অস্থিরতা বা উদ্বিগ্নতায় ভোগলে পুরো পরিবারটিকে অস্থিরতার মাঝে চলতে হয়। কিন্তু এমন লোকের সংখ্যা সমাজে এত বেশি যে গোটা দেশটাই অস্থিরতার আগুনে জ্বলছে। অবশ্য এজন্য সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থ কিংবা দেশের প্রচলিত আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাও অনেকাংশে দায়ী। অবশ্য আশার কথা, রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত রেনুর হত্যাকারীরা গ্রেফতার হয়েছে ও আইনের আওতায় এসেছে। এতে গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারী মৃদু ভারসাম্যহীনরা কিছুটা হলেও নিভৃত হবে।
সোজা কথা এই মূহুর্তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। মনে রাখতে হবে, আমাদের গন্তব্য অনেক দূর;মানসিকভাবে অসুস্থ জাতিকে নিয়ে দূর গন্তব্যে পারি দেয়া আর মরুভূমির মরিচীকার দিকে এগিয়ে যাওয়া একই কথা।
লেখক
প্রধান শিক্ষক
সৈয়দ হাবিবুল হক উচ্চ বিদ্যালয়
বৌলাই,কিশোরগঞ্জ।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.