শিক্ষকের মূল্যায়ন এবং প্রচার অপপ্রচার

একেএম শাহনাওয়াজ

আমি দুটো প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দিয়ে লেখাটির অবতারণা করতে চাই। প্রথমটি ১৯৯২ সালের অভিজ্ঞতা। আমি আকাশ পথে কলকাতা যাচ্ছি। দমদম এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়িয়েছি। সেদিন যাত্রীর চাপ ছিল। একটু কড়াকড়িও দেখলাম। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা করছেন। আমার শিক্ষকতা পেশার জায়গাটি দেখে একগাল হাসলেন। প্রয়োজনীয় সিল-স্বাক্ষর দিয়ে আমাকে সসম্মানে ইমিগ্রেশন পার করে দিলেন। আমি ব্যবহারে অভিভ‚ত হলাম। এক বন্ধু আমাকে নিতে আসবেন। ফোনে জানালেন, তার পৌঁছতে একটু দেরি হবে। আমাকে লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বললেন। প্রায় আধাঘণ্টা পর ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে সেই অফিসার লাউঞ্জের দিকে আসছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। খোঁজখবর করলেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি বিশেষ সম্মান দেখানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘ছি ছি এ কথা বলছেন কেন স্যার, আপনারা শিক্ষক। সবসময়েই নমস্য। আজ আমি যে এখানে আছি সে তো আপনাদের কল্যাণে আপনাদের আশীর্বাদে।’ আমি সেদিন অনুভব করলাম কেন সভ্য দেশগুলো বিবেচনা করে শিক্ষা সবচেয়ে বড় উন্নয়নমূলক খাত। এজন্য সেসব দেশে শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ থাকে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষা ক্ষেত্রকে পরিচালনা করেন শিক্ষক। তাই শিক্ষকের আর্থিক, একাডেমিক এবং সামাজিক মানোন্নয়নে রাষ্ট্রের সতর্ক লক্ষ্য থাকে। শিক্ষাঙ্গনকে রাখতে চায় কলুষমুক্ত।
দ্বিতীয় উদাহরণটি সাম্প্রতিক সময়ের। ২০১৭-এর আগস্ট মাসে আবার দমদম এয়ারপোর্ট হয়ে কলকাতা যাচ্ছি। দমদম এয়ারপোর্ট এখন অনেক বড় ও আধুনিক হয়েছে। নাম পাল্টে হয়েছে নেতাজী সুভাস বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এবার আমার সঙ্গে স্ত্রী-কন্যাও রয়েছে। ইমিগ্রেশন অঞ্চলটি বেশ বড় আর খোলামেলা। আমার পাসপোর্ট পরখ করছিলেন একজন তরুণ অফিসার। আমার শিক্ষক পরিচয়টি জানলেন। জানতে চাইলেন কেন কলকাতায় এলাম। আমার ছুটির কাগজে লেখা ছিল সেমিনারের কথা। জানালাম বর্ধমান রাজ কলেজ ও বারাসাত সরকারি কলেজে দুটো বক্তৃতার জন্য ওরা আমন্ত্রণ জনিয়েছে। অফিসার ভদ্রলোক যথেষ্ট সম্মান করলেন। বললেন, স্যার ছুটি নেওয়ার সুযোগ থাকলে আমি আপনার বক্তৃতা শুনতে যেতাম। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন। আমলানির্ভর রাষ্ট্রে নষ্ট রাজনীতির দলীয় বলয়বৃত্তে বন্দি সরকারগুলো নিজ দৈন্যের কারণে আমলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর সেই সুযোগে কোনো কোনো সংকীর্ণ মানসিকতার আমলা নিজেদের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ভাবতে পছন্দ করেন। সব ক্ষেত্রে অধিকতর জ্ঞানী ভাবতেও আনন্দ পান। তাই অনেক সময় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেও পরোয়া না করে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। এতে মহাঅনর্থ বেধে গেলেও নানা রকম রক্ষাকবজের জোরে দিব্যি দাপটে থাকেন। সরকারি রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গবেষণায় শিক্ষকরা স্বাভাবিক মূল্যায়ন বঞ্চিত হন। জয় হয় রাজনৈতিক পরিচয়ের। এসব কারণে প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকরা স্বাভাবিক মূল্যায়ন বঞ্চিত হচ্ছেন। শিকার হচ্ছেন নানা অপপ্রচারের।
নতুন বেতন স্কেলের পরও প্রাইমরি স্কুলের শিক্ষকরা এখনও বৈষম্যের শিকার। এই বৈষম্যের অবস্থান শিক্ষার সব পর্যায়ে শিক্ষকরা হাড়ে-মজ্জায় টের পান। এরপর যখন সরকারি বিধায়ক থেকে শুরু করে জ্ঞানী-গুণী অনেকে শিক্ষকদের টিউশনি (প্রাইভেট পড়ানো) নিয়ে নীতিকথা বলেন তখন বলতে ইচ্ছে হয় শিক্ষকরা কি তবে জীবন বাঁচাতে ছিনতাই-রাহাজানিতে নামবেন? শিক্ষকরা তো ফাইল আটকে অতিরিক্ত আয় করছেন না তাদের পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র পড়িয়ে আয় করছেন। এতে শিক্ষকদের নিজ পেশায় দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। খবরদারি চলতে পারে সেখানে, যদি শিক্ষক স্কুলে নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা করেন। দরকার ছিল নোট বই, গাইড বইমুক্ত করা। সেখানে তো একটি চমৎকার আপস করে যাচ্ছেন নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী। ব্যক্তিগত টিউশনি নয়, নিয়ন্ত্রণ করা উচিত কোচিং বাণিজ্যের জায়গাটিতে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই। মহাউৎসাহে গাইড বইয়ে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে বইয়ের বাজার আর ছাত্র-শিক্ষকের টেবিল। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলছেন। কিন্তু এর পূর্ব শর্তগুলো কি পালিত হচ্ছে?
নতুন বেতন স্কেল ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। যেখানে সভ্য দেশগুলোতে বেতন ও মর্যাদায় শিক্ষকদের অনেকটা এগিয়ে আলাদা অবস্থানে রাখা হয় সেখানে বড় আমলাদের মাথার ওপর রেখে তিন ধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা। উপাচার্যরা শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেতন কাঠামো সংশোধনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান সর্বোচ্চে রাখার দাবি জানিয়েছিলেন।
এভাবে দাবি জানাতে হয়েছে জেনে আমি লজ্জায় অধবোদন হয়েছিলাম। আমরা কি অন্ধ আর বিবেক বিবেচনাহীন রাষ্ট্রে বাস করছি যে, স্বয়ং উপাচার্যদেরই যেতে হচ্ছে এমন এক দাবি নিয়ে।
এসব দেখে আমার মনে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা কাঠামোর একটি ছবি চকিতে ভেসে উঠেছিল। তখনও বইপত্রের যুগ শুরু হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষার একটি ধারা ছিল গুরুগৃহে জ্ঞানচর্চা।
রাজা-মন্ত্রীর ছেলেরা গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চা করত। গুরু অর্থাৎ সন্ন্যাসীরা বনের ভেতর কুটিরে জীবনযাপন করতেন। ধর্মচর্চা করতেন।
রাজা-মন্ত্রী তাদের ছেলেদের নিয়ে এসে করজোড়ে প্রার্থনা জানাতেন। অনুনয় করতেন গুরু যাতে সন্তানদের দায়িত্ব নেন। রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্ররা গুরুর কুটিরে থেকে গুরুর সেবা করে জ্ঞানার্জন করতেন। এখন সেই সত্য যুগও নেই, শিক্ষকের মর্যাদাও নেই। তাই মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য অপাত্রে ভিক্ষে প্রার্থনা করতে হচ্ছে।
সভ্য দেশগুলোতে বেতন ও সামাজিক অবস্থানে শিক্ষককে অনেক ওপরে রাখা হয়। নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, একটি দেশের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে একটি লাভজনক বিনিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত ও চৌকস জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। নতুন নতুন গবেষণার ফলাফলে দেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গন আলোকিত হবে। তা ছাড়া অন্য সব অঞ্চলের বিনিয়োগ থেকে শিক্ষার বিনিয়োগ অনেক বেশি সুরক্ষিত।
সম্ভবত বছরদুয়েক আগে ইউজিসির এক প্রতিবেদনের কথা পত্রিকায় পড়েছিলাম। সেখানে নাকি বলা হয়েছে, অনেক শিক্ষক একাধিক বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে খÐকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। নিজ নিজ বিশ^বিদ্যালয়ের চেয়ে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন বেশি। যেহেতু আমি পুরো প্রতিবেদন দেখিনি তাই এই দুটো লাইন দিয়ে ইউজিসির বক্তব্যকে সমালোচনা করতে পারব না। তবে এ ধরনের একটি সরলীকরণকৃত কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমার মনে হয়, এ ধরনের অপপ্রচারের অবসান হওয়া উচিত।
প্রথমত বুঝতে হবে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের একটি নগণ্য সংখ্যক শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খÐকালীন শিক্ষকতা করছেন। তাই গড়পড়তা মন্তব্য করার অবকাশ নেই। তা ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ ঢাকায় যতটা আছে সারা দেশে তেমনটা নেই। দ্বিতীয়ত ‘নিজ বিশ^বিদ্যালয়ের চেয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন বেশি’ ধরনের মন্তব্য ভীষণ একপেশে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে সত্য হলেও সার্বিকীকরণের ক্ষেত্রে অন্যায়। সাধারণত নিয়ম মেনেই নিজ নিজ বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে খÐকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। সাধারণত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে দুদিন যেতে হয়। তারপরও গোটা দিন নয় সকালে, বিকালে বা সন্ধ্যায়। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বা একাধিক কোর্সে সাধারণত সপ্তাহে তিনটি ক্লাস নিয়ে থাকেন একজন শিক্ষক। আরও এক দিন থাকে অতিরিক্ত ক্লাস, টিউটোরিয়াল ইত্যাদির জন্য। শুক্রবারসহ বাকি তিন দিন শিক্ষক ব্যক্তিগত কাজ, গবেষণা ইত্যাদিতে ব্যয় করেন। সুতরাং যে শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডলীন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি এই তিন দিনের ভেতর থেকেই সময় বের করে নেন। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কারণে নিজ বিশ^বিদ্যালয়ে সময় দিতে পারেন না ধরনের মন্তব্য বাস্তব বিবেচনাপ্রসূত নয়; বরং শিক্ষকদের হেয় করার একটি অপপ্রচার মাত্র। পাশাপাশি প্রশ্ন থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করাটা কি অন্যায়?
একজন শিক্ষক নিজ শ্রম দিয়ে যদি সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আনার চেষ্টা করেন তাতে অন্যের কষ্ট পাওয়ার তো কিছু নেই। পাশাপাশি এতে শিক্ষকতার চর্চা হচ্ছে বলে সার্বিক বিবেচনায় শিক্ষক তার মানোন্নয়নও করতে পারছেন। আবার বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় যেখানে দেশের মোট শিক্ষার্থীর বড় অংশ পড়াশোনা করে তারা একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের সাহচর্য পাচ্ছে। একে কি জাতীয় স্বার্থে ইতিবাচক হিসেবে দেখব না?
তবে এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যে প্রতিদিন ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ও দেশকে বঞ্চিত করছেন। আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় এর পেছনে দুটো কারণকে দায়ী করে থাকি। এদের ছোট্ট অংশটি ব্যক্তিগত আদর্শ ও নীতিবোধের অভাবে ফাঁকি দিয়ে থাকে। আর বড় ফাঁকিবাজ অংশটির দায় নিতে হবে রাজনৈতিক সরকারগুলোকে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক বলয় তৈরি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের ওপর ভর করে। এখন সরকারি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে মেধার যোগ্যতায় নয়, রাজনীতির ছত্রছায়ায় শিক্ষক হচ্ছেন অনেকে। এ ধারার শিক্ষকদের অনেকেরই শিক্ষকতার দায়বদ্ধতা যতটা না থাকে এর চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে রাজনীতি অঞ্চলের দায় মেটাতে। ক্ষমতা কেন্দ্রে ঘুরে বেড়ানো শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক শিক্ষকের অত সময় থাকে না ক্লাসে বা গবেষণায় ব্যস্ত থাকার। তারা বড় বড় পদাধিকারী হওয়া বা পদাধিকারী বানানোতে বেশি ব্যস্ত থাকেন।
সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কিছু সংখ্যক নীতিভ্রষ্ট শিক্ষককে সামনে রেখে এই পেশায় নিবেদিতপ্রাণ বড় সংখ্যক শিক্ষককে কালিমালিপ্ত করা একটি দুরভিসন্ধি বলেই আমাদের মনে হয়। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কর্তব্য শুধু শিক্ষাদান করাই নয়; শিক্ষা ও গবেষণা দুটো দায় তার কাঁধে। তবে জবাবদিহিতার বাইরে কেউ থাকতে পারে না। শিক্ষকের প্রয়োজনীয় জবাবদিহিতা নেওয়ার যেমন দায়িত্ব রয়েছে সরকারের, তেমনিভাবে শিক্ষককে যথাযোগ্য মর্যাদার জায়গায় রেখে তাকে মূল্যায়ন করার দায়িত্বও নিতে হবে সরকারকেই। তা না হলে মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নত দেশের লক্ষ্যে পৌঁছার যাত্রাপথ বিঘিœত হবে বারবার।

লেখকঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.