এইমাত্র পাওয়া

ভ্রমণকাহিনী: গুরুদুয়ারা নানকশাহী, শিখধর্মের এক অনন্য নিদর্শন

অনিন্দ্য আদিত্য বিশ্বাস: বৈচিত্র্যময় এই বাংলাদেশ! প্রকৃতি, ধর্ম, সংস্কৃতি সবকিছুতেই বৈচিত্র্য। এই দেশে কত রকমের ধর্ম আছে, আছে জাতি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাহাই, শিখ, বিভিন্ন প্রকৃতি পূজারীসহ আরো কত ধর্ম। সব ধর্ম থেকেই অনেক কিছু শেখার আছে। ধর্ম আমাদের নৈতিক শিক্ষা শেখায়। আমাদের দেশেরই এক অনন্য সুন্দর নিদর্শন শিখধর্মের প্রতিষ্ঠান গুরুদুয়ারা। শিখধর্ম বলে অবশ্য এ দেশে স্বীকৃত ধর্ম নেই। তবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ। কারণ, প্রত্যেক মানুষেরই তার নিজ ইচ্ছামতো নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়া উচিৎ। ১৯৬৯ সালের পূর্ব পাকিস্তান গেজেট গেজেট থেকে জানা যায় – সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে শিখদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯%। চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে তাদের বসবাস বেশী ছিল। কিন্তু, বর্তমানে, এর সংখ্যা নেমে ০.০৪% এ নেমে এসেছে। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) হয়ে শিখরাও লড়েছিল। যুদ্ধের সময় খোদ ঢাকার গুরুদুয়ারাতে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়। মটর শেলও পড়ে। বর্তমানেও শিখদের সঠিক সংখ্যা বের করা বেশ কঠিন। দেশে এ ধর্মের উপাসনালয় আছে পাঁচটি। দুটি ঢাকায়, দুটি চট্টগ্রামে এবং একটি ময়মনসিংহে। সিলেটেও একটি ছিল, যেটির অস্তিত্ব এখন পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মঞ্জি হল গুরুদুয়ারা নানকশাহী। যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কলা ভবনের পাশে অবস্থিত। গুরুদুয়ারা নানকশাহী স্থাপন করেন ভোইনান্স। মতান্তরে আলমাস্ত নামের জনৈক শিখ ধর্ম প্রচারক। জানা যায় তিনি মোগল সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৮৩০ খ্রিষ্ঠাব্দে এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গুরুদুয়ারা ভবনের সংস্কার করা হয়। ১৯৮৮-৮৯ এটির ব্যাপক সংস্কার করা হয়। এরপর বাইরের বারান্দা ও সংলগ্ন স্থাপনা যোগ করা হয়। সংস্কার কার্যের অর্থায়ন করা হয় দেশি ও বিদেশে অবস্থানরত শিখ ধর্মাবলম্বীদের দানের মাধ্যমে। ঢাকার আন্তর্জাতিক পাঠ সংস্থার তদানীন্তন প্রধান সর্দার হরবংশ সিং এর নির্মানকাজ তদারক করেন। উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত গুরুদুয়ারা নানকশাহীর বর্তমান প্রবেশপথটি রয়েছে দক্ষিন দিকে, উপাসনালয়টির সামনে রয়েছে চমৎকার সবুজ লন। এর বাম দিকে আছে শিখ গবোষণা কেন্দ্র, ডানদিকে দ্বিতল দরবার হল। সামনে পতাকা টাঙানোর খুটি। এই উপাসনালয়টি শিখদের স্থাপত্যরীতির প্রশংসনীয়তা দাবী রাখে। উপাসনালয়টির ওপর পৃথিবী আকৃতির একটি গম্বুজ বেষ্টনীতে আবদ্ধ।

গুরুদুয়ারা নানকশাহীর মাঝখান রয়েছে একটি বড় কক্ষ, এই কক্ষের চারদিকে আছে চারটি দরজা। মাঝখানে কাঠের তৈরি বেদির ওপর রয়েছে ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থ সাহিব। এটাকে বলা হয় শ্রী দরবার সাহিব। লনের এক পাশে একটি কাঁচের বাক্সবন্দি হয়ে আছে নবম শিখশুরু তেগ বাহাদুর সিংএর ব্যবহৃত একজোড়া খড়ম। যত্নসহকারে রাখা আছে বেদির সামনেও। মেঝে জুড়ে লাল রঙের কার্পেট পাতা, তাতে ভক্তরা বসে ধর্মকথা শোনেন। ধর্মকথার অক্ষর প্রকম্পিত করে চারদিকের বারান্দা।
নানকশাহীতে একেক সময় একেকজন গ্রন্থি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৫-১৯৪৭ পর্যন্ত শ্রীচন্দ্র জ্যোতি নামে এক শিখ সাধু এই উপাসনালয়ের পুরোহিত ছিলেন।

১৯৪৭ সালের পর থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত উপাসানালয়টি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংস্কার করে এর বর্তমান রূপ দেওয়া হয়।

বর্তমানে প্রধান গ্রন্থির দায়িত্ব পালন করছেন ভাই আজাদবিন্দার সিং। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুইবার ধর্মকথা পাঠ ও প্রার্থনা হয়। তাছাড়া প্রতি শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সাপ্তাহিক প্রার্থনা হয়। হয় কীর্তনের আয়োজন। সেইসাথে আগত অতিথিদের জন্য ব্যবস্থা হয় মধ্যাহ্নভোজের। বার্ষিকভোজ হয় গুরু নানক শাহীর জন্মবার্ষিকী, দশম গুরু গোবিন্দ সিং এর জন্মবার্ষিকী, খালসা সাজনা দিবস, নগর কীর্তন, লোহরী এবং পহেলা বৈশাখের সময়। শিখ উপাসনালয়টিতে নেই কোন প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী নারী-পুরুষের রয়েছে প্রবেশাধিকার। যে কেউ অংশ নিতে পারেন প্রার্থনায়। সেই সাথে তৃপ্তিময় প্রাসাদ নিতে পারেন ভক্তিভরে। শিখীদের আতিথ্যেয়তা ও সঙ্গীতময়তার পেছনে রয়েছে গুরু নানকজীর ৩টি কর্তব্যের কথা। পরমাত্মা, অতিথি ও কর্মকে স্মরণ করার প্রত্যাহিক কর্তব্য। পাঞ্জাবী ও ইংরেজি ভাষায় “গ্রন্থ সহিব” -এর অনুবাদ পাওয়া গেলেও বাংলায় তেমন কোন অনুবাদ নেই। একসময় উড়িষ্যা থেকে প্রকাশিত দেবশর্ম্মা চাকলাদারের অনূদিত বাংলা অনুবাদ পাওয়া যেত। কিন্তু সেটিও দুষ্প্রাপ্য। বর্তমানে শিখী অনলাইন প্লাটফর্ম কাজ করছে। কাজ করছে ঢাকার গুরুদুয়ারা নানক শাহীতে অবস্থিত শিখ রিসার্চ সেন্টার।

গুরুদুয়ারা নানকশাহী শুধু শিখধর্মেরই নয়, দেশের জন্যেও এক অনন্য সম্পদ। তাই এ উপাসনালয়কে সংরক্ষণের পাশাপাশি দরকার বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। এর ইতিহাস, ঐতিহ্যকে প্রসার ঘটানো দরকার।

লেখকঃ  ব্যবসা বাণিজ্য বিভাগ, উচ্চমাধ্যমিক ২য় বর্ষ, নটরডেম কলেজ, ঢাকা

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৮/০৭/২০২৫


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading