এইমাত্র পাওয়া

এখনো সরবরাহ হয়নি প্রাথমিক–মাধ্যমিকের ২২ কোটি বই, ব্যাহত হচ্ছে পড়াশোনা

ঢাকাঃ মতিঝিল সরকারি বালক বিদ্যালয়ের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছিল দুই ছাত্র। নবম শ্রেণিতে পড়ে তারা। গতকাল রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কথা হলো ওদের সঙ্গে। নতুন বই পেয়েছে কি না জানতে চাইলে বলল, এখনো একটি বইও পায়নি। পড়াশোনা করো কীভাবে? বলল, পুরোনো বই দিয়ে। গতকাল ক্লাস হয়েছে তিনটি। অপর দিকে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্র বলল, সে এখন পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি ও গণিত—এই তিনটি বই পেয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে মোট বই ১৩টি।

বিদ্যালয়টির প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক বললেন, প্রাথমিক স্তরের সব বই পাওয়া গেছে। আর মাধ্যমিকে নবম বাদে অন্য শ্রেণিগুলোতে তিন থেকে চারটি বিষয়ের বই পাওয়া গেছে। কিন্তু নবম শ্রেণির কোনো বই পাননি।

ঢাকা থেকে প্রায় পৌনে তিন শ কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া মিলেনিয়াম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাতুমনি চাকমা জানান, ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে। আর সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে তিনটি করে। কিন্তু নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটি বইও পায়নি। বই না পেয়ে পিডিএফ (অনলাইন ভার্সন) দিয়ে ক্লাস করানো হচ্ছে।

শুধু রাজধানী ও পার্বত্য জেলার এই দুটি বিদ্যালয়ই নয়, শিক্ষাবর্ষের এক মাস পেরিয়ে গেলেও সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থী এখনো সব বই পায়নি। এর মধ্যে নবম শ্রেণিতে বইয়ের সংকট বেশি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কোনো বই পায়নি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বইয়ের অভাবে বিদ্যালয়ে ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে পড়াশোনা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাবর্ষে চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৪০ কোটি ১৫ লাখ বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ২২ কোটি বই এখনো সরবরাহ হয়নি। মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখের মতো। এর মধ্যে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিকের ১১ কোটি ১৭ লাখ ৮১ হাজার ২৪২টি পাঠ্যবই ছাড়পত্র বা সরবরাহ হয়েছে। তবে সরবরাহসহ ছাপা হয়েছে ১৪ কোটি ১৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৫টি। এর মানে হলো ১৯ কোটি ৭৮ লাখের মতো বই এখনো সরবরাহ হয়নি। আর ছাপার হিসাব করলে প্রায় পৌনে ১৭ কোটি বই ছাপা বাকি।

মাধ্যমিকে বেশি পিছিয়ে রয়েছে নবম শ্রেণির বই ছাপার কাজ। এই শ্রেণিতে মোট বইয়ের সংখ্যা ৬ কোটি ২৮ লাখের মতো। এর মধ্যে ছাপা হয়েছে ১ কোটি ৮১ লাখের কাছাকাছি।

তবে মাধ্যমিকের তুলনায় প্রাথমিকের ছাপা ও বিতরণের পরিস্থিতি ভালো। প্রাথমিকের মোট পাঠ্যবই ৯ কোটি ১৯ লাখের মতো। এর মধ্যে ছাড়পত্র হয়েছে ৭ কোটি ৩ লাখের বেশি। এখনো সোয়া ২ কোটি বই সরবরাহ হয়নি।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা চেষ্টা করছেন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই সরবরাহ করতে। এর মধ্যে প্রাথমিকের অধিকাংশ বই বিতরণ হয়ে গেছে। দশম শ্রেণির বইয়ের ছাপার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সব বই দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর নবম শ্রেণির বই ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

প্রসঙ্গত, নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই এ বছর যারা দশম শ্রেণিতে উঠেছে, তাদের এখন বিভাগ-বিভাজন হচ্ছে। কেবল এই শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এ জন্য এবার তাদের দশম শ্রেণিতে নতুন বই দেওয়া হচ্ছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান এমন চেষ্টার কথা বললেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দিতে এ মাস লেগে যাবে। এমনকি মার্চ মাস পর্যন্ত যেতে পারে।

এবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জনের কারণে বই ছাপার কাজ দেরি হওয়ার কিছু বাস্তব কারণ ছিল। কিন্তু দরপত্র, অনুমোদন, চুক্তির মতো কাজগুলোও যথাসময়ে না করায় এবং কাগজ ও আর্ট কার্ডের সংকটের কারণে আরও বেশি দেরি হচ্ছে।

বই না পাওয়ায় ক্লাসের সমস্যা

গতকাল সকালে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, বিদ্যালয়ের আঙিনায় শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করছে। সেখানে দাঁড়ানো দুই ছাত্রী। দুজনই এবার দশম শ্রেণিতে উঠেছে। এখন পর্যন্ত চারটি বিষয়ের বই পেয়েছে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেল, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব বই পাওয়া গেছে। যদিও যত শিক্ষার্থীর চাহিদা দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে কিছু কম দেওয়া হয়েছে। যেমন ৬০ জনের চাহিদা ছিল, দেওয়া হয়েছে ৫০ জনের। কিন্তু চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত তিন থেকে চারটি বই পাওয়া গেছে। যেমন চতুর্থ শ্রেণির জন্য ৬০ সেট বইয়ের (৬০ জনের জন্য, একেকজনের জন্য ছয়টি বই) চাহিদা ছিল। পাওয়া গেছে ৫০ সেট। তা-ও চার বিষয়ের বই পাওয়া গেছে। এগুলো হলো; বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়। পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য এখন পর্যন্ত তিন বিষয়ের বই পাওয়া গেছে। আর দশম শ্রেণির জন্য পাওয়া গেছে চার বিষয়ের বই।

সব বই না পাওয়ায় ঠিকমতো ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না বলে বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

বিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় ফটকে কথা হয় দশম শ্রেণির এক ছাত্রের সঙ্গে। সে বলল চারটি বই পেয়েছে। বাকি বইয়ের পড়াশোনা পুরোনো বই থেকে করছে।

মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এই বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানালেন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই পাওয়া গেছে। কিন্তু ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম—প্রতি শ্রেণির জন্য তিনটি করে বই পাওয়া গেছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার। এর মধ্যে পাওয়া গেছে ২ লাখ ১৪ হাজার বই। অন্যদিকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানালেন, তাঁরা চাহিদা পাঠিয়েছিলেন ২৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৫টি বইয়ের, পেয়েছেন ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬৪টি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গতকাল পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সব বই পাওয়া গেছে। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছায়নি। এই উপজেলায় প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ২ লাখ ৪৮ হাজার। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৩৯ হাজার বই বিতরণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে সরাইল উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৪ হাজার ৮১৬ শিক্ষার্থীর জন্য বইয়ের চাহিদা ৩ লাখ ২০ হাজার ৮৪০টি। এর মধ্যে পাওয়া গেছে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৯০টি।

উপজেলা সদরে অবস্থিত সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করছে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দেবব্রত দাস প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে শিক্ষকসংকট, অন্যদিকে রয়েছে বইয়ের ঘাটতি। বইয়ের ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হচ্ছে না।

কয়রা উপজেলা সদরের সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণির তিনটি করে বই পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, নবম শ্রেণির জন্য কোনো বই হাতে পাননি। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাবিলা খানম বলে, ‘বই না থাকায় ঠিকঠাক ক্লাস হচ্ছে না। স্যাররা বইয়ের পড়াশোনার বাইরে মৌলিক বিষয়গুলো শেখাচ্ছেন। জানি না কবে বই পাব।’

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৩/০২/২০২৫


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.