শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ অর্থসংকটের কারণে আগে থেকেই বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ–সুবিধার টাকা পেতে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হতো। এখন এই অর্থের সংকট আরও বেড়েছে। পাশাপাশি প্রায় ছয় মাস ধরে অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা বোর্ড অকার্যকর হয়ে আছে। এই দুই কারণে এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা পেতে অপেক্ষাও দীর্ঘ হচ্ছে। অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা মিলিয়ে ৭৪ হাজারের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন অনিষ্পন্ন হয়ে জমা পড়ে আছে।
অবসরের পরপরই অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবতা হলো শিক্ষক-কর্মচারীদের এসব সুবিধা পেতে এখন তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। প্রায় ছয় মাস ধরে বোর্ড সভা না হওয়ায় এবং বোর্ডের নিয়মিত সচিব না থাকায় নতুন করে টাকা দেওয়ার অনুমোদন হচ্ছে না। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের হাহাকারও বাড়ছে।
অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষকদের এই অসহায়ত্ব দেখে তাঁরাও কিছু করতে পারছেন না। তাঁরাও চান, সরকার দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করুক।
সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণ–সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। আর অবসর–সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর–সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে।
রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে কল্যাণ ট্রাস্ট ও বোর্ডের কার্যালয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে এই ভবনে গেলে দেখা যায়, বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাঁদের স্বজনেরা এসেছিলেন অবসর ও কল্যাণ–সুবিধার টাকা পাওয়ার খবর নিতে। কর্মকর্তারা তাঁদের বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এসেছিলেন তাঁর বাবার অবসর–সুবিধার টাকার বিষয়ে। তিনি জানান, তাঁর বাবা গাইবান্ধার একটি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ২০২০ সালে অবসরে গেছেন; কিন্তু এখনো অবসর–সুবিধা পাননি।
অবসর ও কল্যাণ–সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, অবসরের জন্য প্রায় ৩৮ হাজার এবং কল্যাণ–সুবিধার জন্য প্রায় ৩৬ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন হয়ে জমা পড়ে আছে।
অবসর–সুবিধা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদনগুলোর মধ্যে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জমা আবেদনগুলোর বিপরীতে টাকা দেওয়ার অনুমোদন করা হয়েছে। কলেজে তা ওই বছরের মার্চ পর্যন্ত এবং মাদ্রাসার জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্টের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালের মে পর্যন্ত জমা পড়ে থাকা আবেদনগুলোর বিপরীতে টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য সেখানকার একটি সূত্র জানিয়েছে, অনুমোদনের পরও কখনো কখনো টাকা পেতে কিছু সময় লেগে যায়।
বোর্ড অকার্যকর
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব এই দুই প্রতিষ্ঠানে পদাধিকারবলে চেয়ারম্যান হলেও এই দুটি অফিস চলে মূলত সচিবের (সদস্যসচিব ডাকা হয়) নেতৃত্বে। সাধারণত সরকার–সমর্থক শিক্ষকনেতারা এই দুই প্রতিষ্ঠানের সচিব হন। বোর্ডের সদস্যও হন সরকার–সমর্থক শিক্ষক-কর্মচারীরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাদের সময়ে নিয়োগ করা দুই সচিব অফিসে যাননি। অন্য সদস্যরাও প্রায় নিষ্ক্রিয়; কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ছয় মাস হতে চললেও এই দুই প্রতিষ্ঠানের বোর্ড পুনর্গঠন করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে এখন সংকট বেড়েছে।
গত নভেম্বর থেকে অবসর–সুবিধা বোর্ডে সদস্যসচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ। তিনি বলেন, তাঁরা এখন আগে অনুমোদন হওয়া টাকা দিচ্ছেন। তবে গত আগস্টের পর বোর্ডের কোনো সভা হয়নি।
অবসর–সুবিধা বোর্ডে রুটিন কাজ চললেও কল্যাণ ট্রাস্ট প্রায় অভিভাবকহীন। এত দিন এই ট্রাস্টে সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাস্টের কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার; কিন্তু তিনিও সম্প্রতি অবসর–উত্তর ছুটিতে চলে গেছেন। ফলে স্বাক্ষর করার মতো কেউ নেই; অন্য কাউকে রুটিন দায়িত্বও দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
সমাধানে দরকার দুই ব্যবস্থা
অবসর ও কল্যাণ–সুবিধার বড় অংশই আসে মূলত শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে। বর্তমানে অবসর–সুবিধার জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ হারে টাকা কাটা হয়। আর কল্যাণ–সুবিধার জন্য ৪ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখা হয়। এ ছাড়া সরকার মাঝেমধ্যে থোক বরাদ্দ দেয়। এফডিআরের লভ্যাংশ এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে কেটে রাখা টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ–সুবিধার টাকা দেওয়া হয়।
অবসর–সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৬ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে মাসে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আদায় হয়। এফডিআর থেকে মাসে আয় হয় তিন কোটি টাকা। এই দুই খাতে মাসে আয় হয় ৭৩ কোটি টাকা, যা বছরে ৮৭৬ কোটি টাকা। কিন্তু শুধু অবসর–সুবিধার জন্য মাসে প্রয়োজন হয় ১১৫ কোটি টাকা। এই হিসাবে মাসে প্রায় ৪২ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে; যা বছরে ৫০৪ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অবসর–সুবিধা বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, যদি অনিষ্পন্ন সব আবেদন এখন নিষ্পত্তি করতে হয়, তাহলে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এরপর স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দিলে কাউকে আর অবসর–সুবিধার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্টের অনিষ্পন্ন আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে এককালীন ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা দরকার। এরপর প্রতিবছর সরকার ২০০ কোটি টাকা দিলে তা স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই টাকা জোগানের পাশাপাশি বর্তমানে যেটি দরকার, সেটি হলো আইন অনুযায়ী শিক্ষকদের মধ্য থেকে বোর্ড পুনর্গঠন করা। সূত্রঃ প্রথম আলো
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০১/০২/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.