এইমাত্র পাওয়া

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে বহাল তবিয়তে ‘হুইপ স্বপনের ডান হাত’ সেই ইব্রাহিম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ পতিত স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা প্রশাসন পুরোপুরি আওয়ামীকরণ করা হয়েছিল। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত সবাই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বা আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ লাভ করেছে। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা, সততার কোনো মূল্য দেয়া হয়নি। ফলে শিক্ষা প্রশাসনে বেপরোয়া ভাবে অনিয়ম, দুর্নীতি,লুটপাট চলেছে এবং ভেঙ্গে পড়েছিল গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। তবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও আওয়ামী সুবিধা ভোগী এসব কর্মকর্তারা শিক্ষা প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তাদের মধ্যে কয়েকজনের পদায়ন বাতিল করা হলেও এখনও বেশ কিছু আওয়ামী সুবিধাভোগী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বহাল তবীয়তে আছেন। এর মধ্যে একজন রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের (হিসাব ও নিরীক্ষা) উপ-পরিচালক শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। যিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ এবং জয়পুরহাট দুই আসনের সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত। 

গত ২৩ জানুয়ারি “রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের ডিডি পদে পদায়ন পেলেন আ’লীগের হুইপ স্বপনের ‘ডান হাত’!” শিরোনামে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হলে যা নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারদের মধ্যে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিলেও তিনি বহাল তবীয়তে আছেন। এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে তাকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) পদে পদায়নের প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন ৭ আগস্ট ২০১৪ খ্রি. প্রভাষক পদে যোগদানের শুরু থেকেই বগুড়া আজিজুল হক কলেজে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। প্রভাষক থেকে ৩০ অক্টোবর ২০২২ খ্রি. সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে তিন কলেজটির মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। দশ বছর একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পেরেছেন শুধু মাত্র আওয়ামী প্রভাবশালী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ায়।জানা গেছে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার সন্তান মোঃ ইব্রাহিম হোসেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও সরাসরি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ এবং জয়পুরহাট দুই আসনের সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতেন। তিনি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে হুইপ স্বপনের ডান হাত বলে পরিচিত। স্বপনের একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ছবি শিক্ষাবার্তা’র হাতে রয়েছে। 

গত ২৩ জানুয়ারি শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হলে ২৬ জানুয়ারি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড যোগদান করতে যান ইব্রাহিম হোসেন। পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের (হিসাব ও নিরীক্ষা) উপ-পরিচালক পদে যোগদান করেন তিনি।বিসিএস সাধারণ ক্যাডার কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে যোগদান করার ঘটনা শিক্ষা ক্যাডারের ইতিহাসে বিরল।

তবে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান শিক্ষাবার্তা’কে জানিয়েছেন, এই ধরনের কোন প্রটেকশন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড যে থানার মধ্যে পরে সেই থানা থেকে নিয়েছেন কি’না আমার জানা নেই। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড আরএমপি’র রাজাপুর থানার অন্তর্গত। রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম জানিয়েছেন, রাজাপুর থানার পক্ষ থেকে কোন পুলিশ প্রটেকশন চাওয়া হয়নি। 

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের ইতিহাসে পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে কেউ বোর্ডে যোগদান করতে আসেনি। বোর্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এটা নিয়ে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।  কেউ কেউ এটাকে লজ্জাজনক বলেও উল্লেখ করেছেন। 

বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ নিয়ে এসে যোগদান করতে আসা ইব্রাহিম হোসেন যোগদান করেন ২৬ জানুয়ারি বিকেল পাঁচ টার কিছু পর। ১২ টার দিকে ১২/১৩ জন পুলিশ নিয়ে তিনি বোর্ডে উপস্থিত হন। প্রায় তিন চার ঘন্টা তারা বোর্ডে অবস্থান করেন। বিকেল পাঁচ টায় যোগদানের পরে তিনি যখন তার দপ্তরে যান তখন তার সাথে উপস্থিত ছিলেন একাধিক অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি এবং স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের হাত ধরে পদায়ন বাগিয়ে গত চার বছর ধরে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে থাকা বিসিএস সাধারণ শিক্ষার ২৬ ব্যাচারের কর্মকর্তা সহকারী অধ্যাপক মহা: জিয়াউল হক। এছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। 

এদিকে আরএমপি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল যোগদান করা ইব্রাহিম হোসেনের স্ত্রী আরএমপি পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) সাবিনা ইয়াসমিন। মো. ইব্রাহিম হোসেনের সাথে যেহেতু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে  এবং সে বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাই তার স্ত্রী তার জন্য পুলিশ পাঠিয়েছিলেন। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড সংলগ্ন লক্ষ্মীপুর পুলিশ বক্সের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। 

এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান শিক্ষাবার্তা’কে জানিয়েছেন, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের কেউ আরএমপি পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেনি। আমরা কাউকে পুলিশ প্রটেকশন দেইনি। হয়ত বোর্ড সংলগ্ন থানা থেকে চাইতে পারেন। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক ক্ষমতাধর কর্মকর্তার দপ্তরে যান ইব্রাহিম হোসেন। গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করেন। তাকে এই পদে পদায়নের জন্য ধন্যবাদ জানান ঐ কর্মকর্তাকে। পরবর্তীতে ‘আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপনের ডান হাত’ বিষয়ে শিক্ষাবার্তা’য়  প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে ইব্রাহিম ঐ কর্মকর্তাকে জানালে ‘তিনি তাকে পদায়ন করেছেন’ তা বাতিল হবে না বলে ইব্রাহিমকে অভয় দেন ঐ কর্মকর্তা। 

শুধু শিক্ষা ক্যাডারের ইব্রাহিম নয় আওয়ামী লীগের প্রভাবে এক সময়ে  শিক্ষা প্রশাসনে তটস্থ করে রাখলেও পদায়ন বাগিয়েছেন যারা 

গত ৮ জানুয়ারি যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদ পদায়ন পান অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসান। তিনি সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোনের বগুড়ায় সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের ওপর ককটেল মারে ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নেন। সেই কর্মকর্তাকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে পদায়নের পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপর ১০ দিনের মাথায় ২০ জানুয়ারি তাকে ওএসডি করা হয়। অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসান আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন  কলেজের বিভিন্ন তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠে অধ্যক্ষ অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত কর্মচারী দেখিয়ে অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিলের টাকা উত্তোলন, ভুয়া ব্যয় দেখিয়ে বিভিন্ন তহবিলের টাকা লোপাট করা হয়। ম্যাগাজিন তহবিল থেকে ১০ মাসে ১১ লাখ টাকা তোলা হলেও এ সময়ে কোনো ম্যাগাজিনই প্রকাশিত হয়নি। আর অধ্যক্ষের এই দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী প্রভাবশালী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষ যাওয়া, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন ও কলেজ ফান্ডের লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগে অধ্যক্ষ অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানকে সেসময় মাউশিতে ওএসডি করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে এখন পুরষ্কার হিসেবে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক পদে পদায়ন বাগিয়েছেন তিনি।

গত ২৬ জানুয়ারি বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় মোজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফাতেমা হেরেনকে। শেখ হাসিনার পতনের পর বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের উপধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন বাগিয়ে নেন এই কর্মকর্তা। এরপর ৬ অক্টোবর সেখানে যোগদান করতে গেলে তাকে বাধা দেয় শিক্ষার্থীরা। অধ্যাপক ফাতেমা হেরেন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগপন্থী বরিশালের সাবেক মেয়র ও এমপিদের সাথে প্রকাশ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। একই সাথে তিনি ছাত্রদের আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর বিরোধিতা করে বিভিন্ন পোস্ট করেছেন। বনমালী গাঙ্গুলিতে সুপার থাকাকালীন তার স্বেচ্ছাচারিতা চরম আকার ধারণ করেছিল। এ কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন সেখান থেকে। তাকে পুনরায় বিএম কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানছে না। শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পরে এই কর্মকর্তাকে মাউশিতে সংযুক্ত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এবার তিনি বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের সচিব হিসেবে পদায়ন বাগিয়ে নিয়েছেন।

১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসেবে পদায়ন পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ভাগ্নি জামাই ড. ছরওয়ার আলম। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় তিনি মাদরাসা অধিদফতরের প্রশাসন শাখার পরিচালক ছিলেন। ওই সময় শেখ হাসিনা পরিবারের লোক ও গোপালগঞ্জ বাড়ি পরিচয় দিয়ে সব জায়গা প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কথায় কথায় রাষ্ট্রপতির ও আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতা দেখাতেন।

গত ১৬ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পরও মাউশিতে কিছু আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা পদায়ণ পান। তারা বিগত সরকারের বৈষম্যের শিকার দাবি করে শিক্ষা উপদেষ্টার দফতরে গিয়ে টেবিল থাপড়িয়ে পদায়ন নেন। এর মধ্যে রয়েছেন মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক প্রিম রিজভী ও সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মুহাম্মদ সফিউল বশর। প্রিম রিজভী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যানবেইসের উপপরিচালকসহ বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি করেছেন। এক দিনের জন্য তিনি ঢাকার বাইরে যাননি। 

এসব বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩১/০১/২০২৫ 


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.