নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ আওয়ামী লীগের জনপ্রশাসন মন্ত্রী (সাবেক) ফরহাদ হোসেনের একান্ত ঘনিষ্ঠজন এবং ২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানকে গত বছরের ২৯ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে ওএসডি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওএসডি থাকা অবস্থায় বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে গত ২ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি. যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে পদায়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিতর্কের মুখে শিক্ষা বোর্ডটিতে যোগদানের ঠিক ১০ দিনের মাথায় গত ১৯ জানুয়ারি তাকে মাউশিতে ওএসডি করা হয়।
আরও পড়ুন:- রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেন শিক্ষা ক্যাডারের ১৩৪ কর্মকর্তা!
আপাতত অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানের পদায়ন কেন্দ্রিক সমালোচনার অবসান হলেও আরেকটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোঃ ইব্রাহিম হোসেনের পদায়ন নিয়ে। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ এবং জয়পুরহাট দুই আসনের সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ডান হাত ও আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ (তৎকালীন) অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানের আস্তাভাজন এক আওয়ামী দাপুটে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। মোঃ ইব্রাহিম হোসেনকে গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি. রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) পদে পদায়ন করা হয়েছে। নিজেকে জামায়াতের মতাদর্শ বলে এবং আওয়ামী আমলের বৈষম্যের শিকার দাবি করে বিভিন্ন নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করে এই পদায়ন বাগিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে এই কর্মকর্তার দাবি, ‘তার স্ত্রী রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত থাকায় এখানে পদায়ন নিয়েছেন। আওয়ামী আমলের বৈষম্যের শিকার দাবি তার।’
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন ৭ আগস্ট ২০১৪ খ্রি. প্রভাষক পদে যোগদানের শুরু থেকেই বগুড়া আজিজুল হক কলেজে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। প্রভাষক থেকে ৩০ অক্টোবর ২০২২ খ্রি. সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে তিন কলেজটির মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। দশ বছর একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পেরেছেন শুধু মাত্র আওয়ামী প্রভাবশালী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ায়।

জানা গেছে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার সন্তান মোঃ ইব্রাহিম হোসেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও সরাসরি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ এবং জয়পুরহাট দুই আসনের সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতেন। তিনি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে হুইপ স্বপনের ডান হাত বলে পরিচিত। স্বপনের একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ছবি শিক্ষাবার্তা’র হাতে রয়েছে। তিনি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের হাতে গড়া জয়পুরহাট জেলাস্থ বগুড়ার একটা সংগঠনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনও করেছেন। এছাড়াও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি টি জামান নিকেতার একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন মোঃ ইব্রাহিম। তার সাথে বগুড়ায় আওয়ামী লীগের একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচীতেও দেখা গেছে তাকে।

আজিজুল হক কলেজের বিভিন্ন তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠে অধ্যক্ষ অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত কর্মচারী দেখিয়ে অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিলের টাকা উত্তোলন, ভুয়া ব্যয় দেখিয়ে বিভিন্ন তহবিলের টাকা লোপাট করা হয়। ম্যাগাজিন তহবিল থেকে ১০ মাসে ১১ লাখ টাকা তোলা হলেও এ সময়ে কোনো ম্যাগাজিনই প্রকাশিত হয়নি। আর অধ্যক্ষের এই দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী প্রভাবশালী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষ যাওয়া, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন ও কলেজ ফান্ডের লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগে অধ্যক্ষ অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসানকে সেসময় মাউশিতে ওএসডি করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন মোঃ ইব্রাহিম হোসেন। নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে এখন পুরষ্কার হিসেবে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক পদে পদায়ন বাগিয়েছেন তিনি।

জানতে চাইলে পদ বাগানো আওয়ামী আমলের প্রভাবশালী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা সহকারী অধ্যাপক মো. ইব্রাহিম হোসেন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা বঞ্চিত ছিলাম, আমাদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন আছে বগুড়াস্থ জয়পুরহাট কল্যাণ সমিতি। এই সমিতির আমিও একজন সাধারণ সদস্য ছিলাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম হয় এই সমিতির দীর্ঘ ১৫ বছরে অনেক প্রোগ্রাম হয়েছে সেগুলোর কোন একটা ছবি নিয়ে কেউ যদি সুনাম ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করে তাহলে সেটা দুঃখজনক।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক ইউং পরিচালক শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক আমলে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের হয়ে থাকেন তা দোষের কিছু নয়। কিন্তু যারা সে সময় রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন, রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছেন তারা যদি এই বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্রের এই সময়েও শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন তা দুঃখ জনক। পদায়ন কিংবা বদলি যেটাই বলি না কেন, সেটা মন্ত্রণালয় করেছে। আমাদের কিছু বলার নেই। তবে বিষয়টি মন্ত্রণালয় পুনর্বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।
এ বিষয়ে বিএনপির শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের মহাসচিব জাকির হোসেন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আওয়ামী লীগের দোসরদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটার আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কারণ এই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং আওয়ামী লীগের দোসররা মিলেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা কারিকুলাম ধ্বংস করেছে। যার ফলে শিক্ষার্থী অভিভাবক এমনকি শিক্ষকদের পর্যন্ত চারিত্রিক যে দৃঢ়তা সেই দৃঢ়তা নষ্ট হয়েছে এবং নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করেছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পুরো সমাজটা নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে থাকলে নৈতিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হবে। পুরো সমাজটাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কড়া হুশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই অবলিম্বে যে সমস্ত জায়গায় পতিত সরকারের দোসরদের বসানো হয়েছে এবং অতীতে যারা সুবিধাভোগি যারা এখনও বহাল রয়েছে এবং এই ধরনের পদায়ন করা হয়েছে তাদের অপসারণে আমরা ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারকে আল্টিমেটাম দিতে চাই, আপনাদের অনেক কিছু আমরা অবলোকন করছি, পর্যবেক্ষণ করছি আপনারা এই ধরনের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকেন না হলে শিক্ষক সমাজ এর উপযুক্ত জবাব দেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব নুরুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৩/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.