ঢাকাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের জমানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কী ভূমিকা পালন করেছে, এটা নিয়ে কোনো সমালোচনা না করে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যকে দাওয়াত দিয়ে পাপমোচন হবে না। তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
আজ শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আর সি মজুমদার মিলনায়তনে ‘ফ্যাসিবাদের জমানায় শিকারি সাংবাদিকতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তব্যকালে এ মন্তব্য করেন তিনি।
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ সভাপ্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। সেমিনারে আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম; প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন।
সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের একটি বিষয় হচ্ছে অতীতের সিগনেফায়ারগুলো নিজের আত্মস্থ করে নেওয়া। তার টিভির নাম একাত্তর, এটা হচ্ছে ফ্যাসিজমের লক্ষ্মণ। অথবা একুশে—এগুলো হলো আত্মসাৎকরণ। আপনারা বলতে পারেন, এগুলো তো জাতীয় সিম্বল (প্রতীক), নাম দেওয়া সমস্যা নেই। নাম দেওয়া সমস্যা না, নাম দিয়ে যা করে, তা তো ভয়াবহ।’
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের জমানাটা কী; বলা যেতে পারে, ফ্যাসিবাদের জমানা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শুরু হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে এর জয় হয়েছে। তবে এর সূত্রপাত প্রথম মহাযুদ্ধ নয়। ইউরোপে যে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল, বলা হয় মহাবিপর্যয়কর হলোকাস্ট, ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে। ইহুদি ছাড়া অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে। এটাকে আমি ছোট করছি না। তবে এর চেয়ে বড় বড় বিপর্যয়ের ঘটনা দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য আফ্রিকা কিংবা আমাদের দেশেও হয়েছে। এমনকি ৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়, যাকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বলা হয়, সে সময়ও সরকারি হিসাবে ৫ লক্ষ লোক মারা গেছে। বেসরকারি হিসাবে ১২ লক্ষ। কিন্তু এগুলোকে হলোকাস্ট বলা হয় না। এমনকি প্যালেস্টাইনের হলোকাস্টের কথাও বলা হয় না, এগুলো তো ফ্যাসিবাদ।’
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, ‘সাংবাদিকতা শুধু জনমত তৈরি করে না, এটা রাজনৈতিক মতও তৈরি করে; থিওরি তৈরি করে, ক্ষমতাও তৈরি করে। ফ্যাসিবাদের উদাহরণ হিসেবে বলি, ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্ণ হয় ঢাকার। সেসব পত্রিকা আমি দেখেছি, তারা বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। ভারত সংখ্যা, পাকিস্তান সংখ্যার বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল; কিন্তু ২০০৭ সালে ১৫০ বছরপূর্তিতে ঢাকার কয়েকটি দুর্বল পত্রিকা ও টিএসসিতে কয়েকজন বামপন্থীরা কিছু বক্তব্য দিয়েছিল। সরকারিভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। পলাশীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ নেই, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের উল্লেখ নেই, এমনকি ৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে, তারও কোনো স্বীকৃতি নেই।’
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, ‘ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর আমরা পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালন করেছি। পাকিস্তানিদের বিরোধের কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে, এটা কার্পেটের নিচে চাপিয়ে দেওয়া এমনভাবে, এটা যেন ঘটে নাই; এটাই ফ্যাসিবাদ। গ্রাফিতি আঁকা নিয়ে আক্রমণ করা, এটাও ফ্যাসিবাদ, মানে ফ্যাসিবাদ এখনো জীবন্ত আছে। আন্দোলনে যারা বীরের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের পেটানো হচ্ছে, এটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ফ্যাসিবাদ আমাদের শিক্ষকদের ভেতর আছে, ছাত্রদের ভেতর আছে। এটা শুধু বিশেষ নামধারী রাজনৈতিক দলের মধ্যে নয়, এটা আমাদের পাঠ্যপুস্তকপ্রণেতাদের মাঝে আছে, আমাদের পাঠ্যপুস্তক কারা প্রণয়ন করেছে, যারা আমাদের দেশকে বাংলা অঞ্চল হিসেবে প্রণয়ন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসপন্থী শিক্ষকেরা এটা করেছে, তারা এখনো চাকরিতে বহাল আছে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘শিকারি সাংবাদিকতাকে সাংবাদিকতায় দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি বলা যায়। এর ভয়াবহতা সবাই বুঝি। ফলে যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক থাকতে হবে।’
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আ-আল মামুন বলেন, বিগত সরকারের সময়ে হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের ব্যক্তিজীবন ঘিরে হেনস্তা; গুলশানে মুনিয়া হত্যাকাণ্ডে সায়েম সোবহান আনভীরের সম্পৃক্ততা; পরীমণির বাসায় মধ্যরাতে র্যাবের অভিযান এবং সেটি টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচার কিংবা প্রথম আলোর স্বাধীনতা দিবসে ‘মাছ-মাংসের স্বাধীনতা’ শীর্ষক ফটো কার্ড—প্রভৃতি ঘটনা শিকারি সাংবাদিকতার অন্যতম উদাহরণ।
আ-আল মামুন বলেন, ভারতবিরোধিতার কারণে এবং শেখ হাসিনার কথা না শোনায় মামুনুল হকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করে তাঁকে যেভাবে সেদিন হেনস্তা করে মিডিয়ায় চরিত্র হনন করা হয়েছিল; মুনিয়া এবং তাঁর বোনকে অর্থলোভী সাব্যস্ত করা; পরীমণিকে একেকটা প্রেমিক বদলান, মদ ইত্যাদিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোনো না কোনোভাবে মিডিয়ার একটি অংশ শিকারি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ ধরনের সাংবাদিকতায় মিডিয়া, গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারের একটা অংশ একসঙ্গে কাজ করে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৭/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.