ঢাকাঃ নিজেদের পদ-পদবি, মান-মর্যাদাসহ বিভিন্ন চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন ও ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে রীতিমতো ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ইতোমধ্যেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা সচিবালয়ের ভেতর-বাইরে বড় ধরনের ‘শোডাউন’ করেছেন। সেখান থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানকে অপসারণে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। পাশাপাশি দাবি-দাওয়া নিয়ে সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। অন্যদিকে দাবি আদায়ে সংবাদ সম্মেলন, কলমবিরতি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে ২৫ ক্যাডারের কোনো কোনো সংগঠন।
শুধু তাই নয়, ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’র ব্যানারে ৩ জানুয়ারি তারা খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রমের ওপর একরকম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে নাগরিক সেবা এবং দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন তারা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে কিছু সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন উপসচিব ও তদূর্ধ পদে পদোন্নতির আনুপাতিক হার হবে ৫০:৫০। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পাবে ৫০ শতাংশ এবং আদার্স ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পাবে ৫০ শতাংশ।
তিনি আরও বলেছেন, উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি হবে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। লিখিত পরীক্ষা নেবে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। ৭০ নম্বরের কম পেলে পদোন্নতি দেওয়া হবে না। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের আদলে আলাদা সার্ভিস হিসাবে নিয়ে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হবে। কমিশন প্রধানের এমন বক্তব্যের পর থেকেই ক্যাডার সংগঠনগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ ও অস্থিরতা।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, তাদের এই আন্দোলন কর্মসূচি আলটিমেটাম এবং মহাসমাবেশ সম্পূর্ণ বেআইনি। তারা আইন, বিধিবিধান উপেক্ষা করে এসব করছেন। এসব আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি। একজন সরকারি কর্মচারী সর্বোচ্চ কোনো বিষয়ে আবেদন করতে পারেন। সেখানে তারা আন্দোলন করছেন, আলটিমেটাম দিচ্ছেন এবং মহাসমাবেশ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, তাদের এসব অপকর্মের ফলে জনসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রশাসন সম্পর্কে গণমানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এসব দেখে সরকার নির্বিকার বলে মনে হচ্ছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রশাসন ও ২৫ ক্যাডার সরকারকে জিম্মি করে ফেলেছে। ফলে জনসেবা ও দাপ্তরিক কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি কর্মচারীরা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আইনগত সুযোগ নেই। আক্রমণাত্মক ভূমিকা সরকারি চাকরির আচরণ বিধিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি’। এরপরও যদি আইন ও বিধি উপেক্ষা করে তারা আন্দোলন ও পালটাপালটি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকে তাহলে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সরকারের কঠোরহস্তে এসব বিশৃঙ্খলা দমন করা উচিত। ক্যাডার কর্মকর্তারা যদি সার্ভিসের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করেন, তাহলে অন্য কর্মচারীরা তাহলে কি শিখবেন।
ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, তারা তো ট্রেড ইউনিয়ন নয়। তারা তো কালেক্টটিভ বার্গেইনিং এজেন্টের (সিবিএ) ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। তারা ক্যাডার কর্মকর্তা অথচ কথাবার্তা ও আচরণ সিবিএর মতো। তিনি সব ক্যাডার সংগঠনকে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, জনসেবা যাতে কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয় সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আমরা জনসেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক প্রফেসর ড. মফিজুর রহমান বলেন, আমরা প্রশাসন ক্যাডারের কাছে পরাধীন। তারা আমাদের সব পদ দখল করে রেখেছেন। তাদের কারণে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি না। জেনারেল ও টেকনিক্যাল সব বিষয়ে তারা নাক গলান। তারা যে বিষয় বোঝেন না সেই বিষয়েও মাতব্বরি করেন। এতে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা পরাধীনতা অনুভব করছি। এই আন্দোলনের ফলে জনসেবা ও দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে ড. মফিজুর রহমান বলেন, ২৫ ক্যাডারের কর্মসূচি সরকারি বন্ধের দিনগুলোতে দিয়েছি। আমরা ৩ জানুয়ারি শুক্রবার ঢাকায় মহাসমাবেশ করব। তিনি আরও বলেন, আমরা আন্দোলন করতে চাই না। আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিলেই আমরা ঘরে ফিরব।
প্রশাসন ক্যাডারের দাবি : বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্যাহ গত বুধবার বিয়াম মিলনায়তনে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেন (প্রশাসন ক্যাডার) আমরা এক আছি, এক থাকব। দ্বিতীয়ত, আমরা প্রশাসন ক্যাডারের ওপর কোনো রকমের সার্জারি বা কাটাছেঁড়া আরোপ করতে দেব না। তৃতীয়ত, কমিশন কোনো অযাচিত সুপারিশ করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। চতুর্থত, প্রশাসনে কোনো পর্যায়ে অন্ধভাবে বহিরাগত কাউকে বসানোর চেষ্টা করা হলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। পঞ্চম, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত কর্মকর্তাসহ সব ধরনের কর্মকর্তাকে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ষষ্ঠত, দেশকে কোনোভাবে অস্থিতিশীল করার জন্য যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার জন্য প্রশাসন সারা দেশে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করবে। এ সময় উপস্থিত সংগঠনের সদস্যরা তাতে সম্মতি দেন। ওই প্রতিবাদ সভায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, উপসচিব সরকারের নয় বরং প্রশাসন ক্যাডারের পদ। উপসচিব পদে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ কোটা বাতিল করতে হবে। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার ৫০ শতাংশ, আদার্স ক্যাডার ৫০ শতাংশ করার যে প্রস্তাব জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান করেছেন তা তারা প্রত্যাখ্যান করেন। একই সঙ্গে উপসচিব পদে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিরোধিতা করেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস চালুর দাবি জানান।
জানতে চাইলে বিএএসএর সভাপতি ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্যাহ বলেন, আমরা একটি ক্যাডার। একটি ক্যাডার তাদের অধিকারের কথা বলছে। পক্ষান্তরে ২৫টি ক্যাডার তো সিবিএর মতো আচরণ করছে। আমরা তো মানববন্ধন, কলমবিরতি কিংবা মহাসমাবেশ করিনি। তারা মানববন্ধন, কলমবিরতি এবং মহাসমাবেশ করছে। আমরা তো নতুন কোনো কর্মসূচি দিইনি। তারা দিচ্ছে। বিষয়গুলো সরকার বিবেচনা করবে। তিনি আরও বলেন, আমরা জনসেবা বা দাপ্তিরিক কাজ বিঘ্নিত হওয়ার মতো কোনো আচরণ এখনো করিনি।
২৫ ক্যাডারের দাবি : পক্ষান্তরে প্রশাসন ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের পদোন্নতির প্রস্তাব সমর্থন করে বাস্তবায়নের দাবি জানান। তারা পদোন্নতির আনুপাতিক হার ৫০:৫০ করার দাবি জানান। একই সঙ্গে তারা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ সমর্থন করেন। তারা প্রশাসন ক্যাডারের ন্যায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি জানান। একই সঙ্গে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে ক্যাডারের বাইরে নেওয়ার যে খসড়া প্রস্তাব সংস্কার কমিশন থেকে করা হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৯/১২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.