এইমাত্র পাওয়া

১৫ বছর পর দেশেই ছাপা হবে সব পাঠ্যবই, এখনো শেষ হয়নি দরপত্র

শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দীর্ঘ ১৫ বছর পর এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব পাঠ্যবই ছাপা হবে দেশের ছাপাখানায়। এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর পাঠ্যবইয়ের একটি বড় অংশ ভারত থেকে ছেপে আনা হতো। এবার ভারতে বই ছাপার কাজ দেওয়া হয়নি। এদিকে নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ এবং পাঠানো সম্পন্ন করতে হাতে রয়েছে মাত্র ৪৭ দিন। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি কয়েকটি শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ। চলছে কয়েকটি শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়াও।

রীতি অনুযায়ী এবার গত জুন মাসে টেন্ডার হলেও সেপ্টেম্বর তা বাতিল করে নতুন সরকার। আবার বদলানো হয় শিক্ষাক্রম। নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণিতে অন্যান্য সাবজেক্টের সঙ্গে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে যুক্ত হচ্ছে আরবি। নতুন সাবজেক্ট যুক্ত, মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন আর ২০১২ সালের কারিকুলামে ফেরায় গতবারের চেয়ে এবার ৯ কোটিরও কিছু বেশি পাঠ্যবই বাড়তি ছাপাতে হবে।

তবুও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই সব পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। যদিও দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি বলছে, মার্চের আগে সব বই প্রস্তুত করা সম্ভব হবে না।

এদিকে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথমদিকেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (বাংলা ও ইংরেজি ভার্শন) এবং দাখিল ও কারিগরির ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠ্যবই হাতে পাবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি ভার্শনের পাঠ্যপুস্তক এবং কারিগরি বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। শিক্ষার্থীরা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথমদিকেই পাঠ্যপুস্তক পাবে। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

ছাপা হবে ৪০ কোটিরও বেশি বই: এবার মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৪১ হাজার ৪৮৬টি ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই ছাপানো হবে। এসব বই ছাপানো ও বিতরণে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এবার কাগজের পুরুত্ব ও উজ্জ্বলতা বাড়ানোর সিদ্ধান্তও হয়েছে। গত বছর কাগজের পুরুত্ব ছিল ৭০, আর উজ্জ্বলতা ছিল ৮০। এ বছর কাগজের পুরুত্ব ৮০ এবং উজ্জ্বলতা ৮৫ করা হয়েছে। তবে মুদ্রণ শিল্প সমিতির আশঙ্কা, বেঁধে দেওয়া মানের কাগজ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান মাত্র ছয়/সাতটি হওয়ায় সেখানেও সংকট হতে পারে। পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশকরা জানান, আশা করা যাচ্ছে প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই জানুয়ারির ১ তারিখেই শিক্ষার্থীদের হাতে উঠবে। ডিসেম্বরের ভেতর দেশের সব উপজেলায় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইও পৌঁছে যাবে। তবে বিপত্তি তৈরি হবে মাধ্যমিক স্তরের বই নিয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাপাখানা মালিকরা বলেন, প্রতি বছর মে-জুন মাসে বই ছাপার কাজ শুরু হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বইয়ের অর্ধেক ছাপানো শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখনো সব টেন্ডার প্রক্রিয়ায় শেষ হয়নি। যে কারণে কিছু বই জানুয়ারিতে আর অধিকাংশ বই শিক্ষার্থীদের হাতে উঠতে মার্চ মাস পর্যন্ত লাগতে পারে।

এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের সব পাঠ্যবই প্রস্তুত করে পাঠানোর টার্গেট নেওয়া হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ৯০ ভাগ বই এবং বাকি ১০ ভাগ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তুত করার লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত ও জরুরি ভিত্তিতে এবার ১ কোটি পাঠ্যবই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। এ কারণে তারা মনে করছেন যে, হাওয়ায় বই বানিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে ডেলিভারি দিয়ে দেবে। মার্চের আগে সব বই প্রস্তুত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এনসিটিবির একজন সদস্য বলেন, এ বছর বইয়ের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে শিক্ষা উপদেষ্টা বিশেষ আন্তরিক। যে কারণে কাগজ ও প্রিন্টে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। গুণমান নিয়ে কোনো আপস করবে না এনসিটিবি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্টের পর দেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিলের জন্য তীব্র গণদাবি তৈরি হয়। ফলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি পুরোনো কারিকুলামেও ফিরে যায়নি। দুটি কারিকুলাম থেকে সমন্বয় করে নতুন করে সিলেবাস প্রস্তুত করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ২০১২ সালের কারিকুলামই মোটাদাগে থাকছে। নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যান্য সাবজেক্টের সঙ্গে অতিরিক্ত সাবজেক্ট হিসেবে যুক্ত হচ্ছে আরবি। আর উচ্চমাধ্যমিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে চার জন লেখকের লেখা বা প্রবন্ধ বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়া তিন জন লেখকের কবিতা ও গল্প পরিবর্তন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পাঁচ জন লেখকের কবিতা ও প্রবন্ধের অনুশীলনীতে সম্পাদনা বা পরিমার্জন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাদ পড়া লেখকের তালিকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও জাফর ইকবালও রয়েছেন।

সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত কারিকুলাম-সম্পর্কিত কমিটি গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের রিভিউ-কৃত পাঠ্যপুস্তকগুলোর তালিকা অনুমোদন দিয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২০১২ সালের কারিকুলামের আনন্দ পাঠ নামে দ্রুত পাঠ (বাংলা রেপিড) যুক্ত করা হচ্ছে। অবশ্য ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের কারিকুলামে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনা হচ্ছে একাদশ/দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা সাহিত্য পাঠের সংকলনে। এখানে মোট ২৮টি গদ্য এবং ২৮টি পদ্য রয়েছে। এখান থেকেই বাছাই করা গল্প ও কবিতা নিয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এ বছর এই সিলেবাসের গল্প-কবিতা বাছাইয়েও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর মধ্যে তিন জন লেখকের রচনা পরিবর্তন করা হচ্ছে। পাঁচটি রচনার অনুশীলনীতে পরিমার্জন আনা হচ্ছে। আর চার জন লেখকের লেখা বা রচনা পুরোপুরি বাদই দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, প্রমথ চৌধুরীর বর্ষা প্রবন্ধের পরিবর্তন করে সেখানে যুক্ত হচ্ছে সাহিত্যের খেলা, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের গৃহ পরিবর্তন করে যুক্ত করা হচ্ছে অর্ধাঙ্গী, কাজী নজরুল ইসলামের আমার পথ পরিবর্তন করে যুক্ত করা হচ্ছে যৌবনের গান। অন্যদিকে বাদ পড়া লেখক ও তাদের রচনার তালিকায় রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সংকলন বায়ান্নর দিনগুলো, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও তার লেখা মহাজাগতিক কিউরেটর, দিলওয়ার ও তার লেখা মানুষ সকল সত্য এবং মহাদেব সাহা ও তার লেখা শান্তির গান।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দেওয়াল চিত্রকে বেছে নেয়। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও পুরো ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেওয়ালে শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতি আঁকে। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, জুলাইয়ের গ্রাফিতি যে সব বইয়ে যাবে, তা নয়, কিছু কিছু বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে যেহেতু ২০২৪-এর জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের বিষয়টি একেবারেই সাম্প্রতিক এবং তা নিয়ে লেখা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ বছর সময়ও একেবারেই কম, ফলে লেখা হিসেবে না রেখে কিছু পাঠ্যবইয়ে অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি বা দেওয়ালে আঁকা ছবি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। বাংলা, ইতিহাস, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের মতো কিছু বইয়ের প্রচ্ছদে বা বইয়ের কোনো কোনো অংশে এসব গ্রাফিতি বা দেওয়ালে আঁকা ছবি যুক্ত করা হবে। এছাড়া বেশ কয়েকটি শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেসব ছবি ও উদ্ধৃতি রয়েছে, সেগুলো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৪/১১/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.