নিজস্ব প্রতিবেদকঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তের কথা শুনেই তদন্ত কর্মকর্তারা মাদ্রাসায় পৌঁছানোর পূর্বেই অন্য মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভাড়া করে এনে নিজের শিক্ষার্থী বলে চালিয়ে দিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার হুলিয়ারপাড়া জামেয়া কাদেরিয়া সুন্নিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজ (ইনডেক্স নং— ৩২০৮৫৮)।
মঙ্গলবার সকালে মাদ্রাসাটিতে তদন্তে আসেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা পরিদর্শক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন ও অডিট অফিসার মোঃ মতিয়ার রহমান। তারা মাদ্রাসাটিতে সকাল সাড়ে দশটায় পৌঁছানোর এক ঘন্টা আগেই মাদ্রাসাটিতে মাদ্রাসার ভাড়া করা শিক্ষার্থী নিয়ে এসে নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী দেখানোর উদ্দেশ্যে তাদের মাদ্রাসাটিতে হাজির করেন। এসময় মাদ্রাসার প্রবেশ পথের পাশেই অন্তত ১০ টি সিএনজি দেখা যায়।
সিএনজি চালকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, তাদের সিএনজিতে যে শিক্ষার্থী তারা এই মাদ্রাসায় এনেছেন তার অধিকাংশই কুবাজপুর শাহজালাল (রঃ) সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, এর বাইরে মিয়ার বাজার মাদ্রাসা ও চিলাউরা মাদ্রাসার বেশ কিছু শিক্ষার্থী ছিল।। আমাদের সিনজি আগেই রিজার্ভ করে রেখেছিলেন হুলিয়ারপাড়া জামেয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজ। আমরা শিক্ষার্থীদের বিকেল হলে তাদেরকে আবার নিয়ে যাব।
সিএনজি চালকরা আরও জানান, তাদের দুই দিনের জন্য বলা হলেও পরে বলা হয় একদিনের কথা। মঙ্গলবার এবং বুধবার তাদের এই শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু মঙ্গলবার বলে দেওয়া হয় আর লাগবে না। কি কারণে লাগবে না তা আমাদের জানাই নি।
তবে মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দিনের তদন্তের কথা বলা থাকলেও তদন্তে যেসব কাগজপত্র মাদ্রাসা অধ্যক্ষের কাছে চাওয়া হয়েছে সেগুলো তিনি দিতে পারেননি বলে সময় নিয়েছেন। ফলে দুই দিনের তদন্ত একদিনেই শেষ করে ফিরে গেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়ে আসা এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই কুবাজপুর শাহজালাল (রঃ) সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। প্রবাসীদের অর্থায়নে চলা নন এমপিও এই মাদ্রাসার নেই কোন স্বীকৃতি এবং পরীক্ষার অনুমতি। ফলে নামে মাত্র প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে এর সব শিক্ষার্থীকে খাতা কলমে ভর্তি দেখানো হয় র হুলিয়ারপাড়া জামেয়া কাদেরিয়া সুন্নিয়া আলিম মাদ্রাসার নামে। বিষয়টি নিয়ে এর আগে গত ১৩ মে, ২০২৪ ইং তারিখে ‘ধার করা’ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে হুলিয়ারপাড়া মাদ্রাসা ও দাখিল পরীক্ষা! শিরোনামে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জানা গেছে, মাদ্রাসার উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সুবিধার্থে লন্ডন প্রবাসী কর্তৃক ব্যাংকে প্রদত্ব ৪০ লাখ টাকা অন্যান্যদের সহযোগিতায় আত্মসাৎ করা, অর্থ আত্মসাতের মামলায় ১৬ দিন জেল খাটা, জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ, একই সাথে দুই পদে চাকরি, অর্থের বিনিময়ে বয়স ও কাবিন জালিয়াতি করে বাল্য বিবাহ দেওয়া, ভুয়া আবেদন ও স্বারক ব্যবহার করে হবিবপুর কেশবপুর ফাজিল মাদ্রাসার গভর্নিং বডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনয়ন নেওয়া, ‘ধার করা’ শিক্ষার্থী দিয়ে মাদ্রাসা পরিচালনাসহ একাধিক অনিয়মের অভিযোগে অধ্যক্ষ মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।
এর আগে এই অধ্যক্ষের একাধিক অনিয়ম নিয়ে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশের জেরে তাকে শোকজ করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। তাছাড়াও অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলাম পারভেজের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আরও একটি তদন্ত চলমান রয়েছে।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক গতকাল মঙ্গলবারের সরেজমিনে মাদ্রাসার তদন্তকালে তদন্ত সূত্র বলছে, অন্তত ১৫ টি অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তকালে অভিযোগের বিরুদ্ধে সুনির্দষ্ট কোন তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এই অধ্যক্ষ। তিনি দশদিনের সময় নিয়েছেন নিজের স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণ সরবরাহ করার। প্রবাসী কর্তৃক ব্যাংকে প্রদত্ব ৪০ লাখ টাকা অন্যান্যদের সহযোগিতায় আত্মসাৎ করার অভিযোগের সুর্নিষ্ট প্রমাণ থাকলেও বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভুলভাল বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি।
মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী জানান, অধ্যক্ষ মঈনুলের কারণে এই মাদ্রাসাটি বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। নামে মাত্র শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। অধ্যক্ষের জালিয়াতিতে ডুবতে বসা মাদ্রাসাটি বাঁচাতে হলে তার বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক অনিয়মের অভিযোগের সুষ্ঠ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী তা না হলে শুধু মাদ্রাসাটিই থাকবে, থাকবে না কোন শিক্ষার্থী।
ধার করা শিক্ষার্থীর বিষয়ে জানতে চেয়ে অধ্যক্ষ মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত হয়েছে। অধ্যক্ষ তার স্বপক্ষে কাগজপত্র দিতে সময় চেয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিব।
উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের গত ২৯ জুলাই অধ্যক্ষ মোঃ মইনুল ইসলাম পারভেজ এর বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগে জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে চিঠি ইস্য করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-বশিরুল ইসলাম নিজে তদন্তকারী কর্মকর্তা হলেও অভিযুক্ত মইনুল ইসলাম পারভেজের সাথে তার ব্যক্তিগত সখ্যতা থাকায় একসাথে একাধিক বৈঠক করেন। তদন্তে মইনুল ইসলাম পারভেজকে অভিযোগের হাত থেকে রক্ষা করতে ইউএনও আল-বশিরুল ইসলাম ইউনএনও হবার পূর্বে জগন্নাথপুর উপজেলা প্রাথমিক অফিসের সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার সুবাদে তদন্তের দায়িত্ব দেন জগন্নাথপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুল আলমকে। শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুল আলম নিজ দায়িত্বে এবং ইউএনও’র নির্দেশের নিজের ইচ্ছেমত এক পাক্ষিক তদন্ত করেন । গত ২৯ জুলাই মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্তের নির্দেশনার দের মাস অতিবাহিত হলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত মাদ্রাসা অধিদপ্তরে জমা পরেনি।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৮/০৯/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.