যেভাবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নেয় নওফেলের পরিবার

শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দুই দশকের বেশি সময় আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) শিক্ষা কার্যক্রমের সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। চসিকের জমিতে, সংস্থাটির অর্থায়নের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি সাত বছরের বেশি সময় ধরে বেআইনিভাবে দখলের অভিযোগ উঠেছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর পরিবারের বিরুদ্ধে। চসিকের পক্ষে আদালতের রায় থাকার পরও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দখল করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের পারিবারিক সম্পদের মতো। দখলকে স্থায়ী করতে ট্রাস্টি বোর্ডে যুক্ত করা হয়েছিল এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদসহ তার পরিবারের তিন সদস্যকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব না থাকায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয় থেকে হচ্ছে বঞ্চিত।

চসিকের সূত্রে জানা গেছে, সিট করপোরেশনের প্যাডে সরকারি দপ্তরে করা আবেদনের ভিত্তিতে ২০০২ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায় সিটি করপোরেশন। সংস্থাটির মালিকানাধীন ভবনে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরুতে চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এরপর প্রবর্তক সিএসসিআর হাসপাতালের বিপরীতে এবং নগরীর ওয়াসা মোড়ের ফিলিং স্টেশনের উপরে সিটি করপোরেশনের দুটি জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হয়। তিনটি ভবন নির্মাণসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মোট ৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের মোট ১৪টি বিভাগের ৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী আছে। শতাধিক শিক্ষকসহ মোট তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়টির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৭১ কোটি টাকা।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের বাবা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে। ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে এম মনজুর আলমের কাছে পরাজয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদও হারান তিনি। তবে মেয়র মনজুর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় মহিউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব। কারণ নাছিরের সঙ্গে মহিউদ্দিনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ পুরনো। ২০১৫ সালের ১৪ই জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক চিঠি দিয়ে নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে সম্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্যানেলসহ ঘাটতি পদগুলো পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে। পাশাপাশি সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ড নিবন্ধন করা হয়নি জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে বলা হয়। এ ছাড়া একটি চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট (সিএ) প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের হিসাব নিরীক্ষা করতে বলা হয় ওই চিঠিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি কুক্ষিগত করতে সহযোগিতা করেন ইউজিসি’র সাবেক ২ সদস্য অধ্যাপক আবু তাহের ও অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন। তবে ইউজিসির চিঠিটি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার বরাবর দেয়া হলো না, এই যুক্তি তুলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন মহিউদ্দিন। বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের সম্পৃক্ততা ও হস্তক্ষেপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই প্রশ্ন তুলে তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। আদালত রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে মহিউদ্দিনের অংশগ্রহণে কোনো ধরনের বাধা না দেয়ার নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে মহিউদ্দিন কেন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে পারবেন না, তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেছিলেন উচ্চ আদালত। ২০১৬ সালের ১২ই জুন দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মহিউদ্দিনের পিটিশন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। তবে ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৮২ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২-এর কোনোটিতেই সিটি করপোরেশনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। যদিও ওই মামলা চলাকালে চসিককে দেয়া সেই চিঠিটি বাতিল করে ইউজিসি। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। ২০১৭ সালের মে মাসে রিভিউ পিটিশনের রায়ে উচ্চ আদালত উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কোনো পক্ষের ওপর প্রযোজ্য হবে না।

এ রুলের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবার লিভ টু আপিল পিটিশন করেন মহিউদ্দিন। কিন্তু এর শুনানিতে তিনি হাজির না হওয়ায় ২০১৯ সালের ৭ই জানুয়রি লিভ টু আপিলটি খারিজ করে দেন আদালত। উচ্চ আদালতের মামলটি খারিজ হওয়ার পর দেওয়ানি আদালতে কোনো মামলা করেননি মহিউদ্দিন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনায় চসিকের সব ধরনের বাধা কেটে যায়। কিন্তু মেয়রকে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়নি। ২০১৯ সালে নতুন সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহিউদ্দিনপুত্র নওফেল। তখন তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে পছন্দমতো ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ছাড়া দলীয় হাইকমান্ডের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তৎকালীন মেয়র নাছির উদ্দীন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন নওফেল।

চসিকের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আদালতে হেরে গিয়েও মহিউদ্দিন পরিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে চাপে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নিয়েছিলেন। বিষয়টি সিটি করপোরেশনের সবাই জানেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ১২ সদস্যের মধ্যে তিনজনই মহিউদ্দিন পরিবারের। বোর্ডের চেয়ারম্যান নওফেল, আর তার মা হাসিনা মহিউদ্দিন ও ছোট ভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী সদস্য হিসেবে আছেন। এর বাইরে ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন এস আলম গ্রুপের তিনজন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন, রেমন্ড আরেং, প্রকৌশলী শহীদুল আলম ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মূসা।

জানা যায়, ২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার রাজনৈতিক উত্তরসূরী হন বড় ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বাবার মৃত্যুর পর তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নেন বলে জানান চসিক কর্মকর্তারা। ২০১৯ সাল থেকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং ২০২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী হলেও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েননি নওফেল। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়টি পারিবারিক ও রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার প্রভাবের কারণে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে ইউজিসির মতামত নেয়া হতো না। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এককভাবে নওফেলের সিদ্ধান্তেই চলতো বিশ্ববিদ্যালয়টি। এদিকে প্রায় ১৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক অনুপম সেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭৫ বছর বয়সের পর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও ৮৪ বছর বয়সেও উপাচার্য পদে আছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি একইসঙ্গে ট্রাস্টির সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যিালয়ের উপাচার্যও।

ইউজিসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরও নওফেল ট্রাস্টি চেয়ারম্যানের পদ না ছাড়ায় স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছিল। একইসঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ছিলেন। এ কারণে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি। একই ঘটনা উপাচার্য ও ট্রাস্টি সদস্য অনুপম সেনের ক্ষেত্রও। তিনিও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটিকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এদিকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠানটি একান্ত আমাদের। তবে এটা ছিনতাই করা হয়েছে। এখন সেটি আবার ফিরে পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে কিছু কাগজপত্র পাঠিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই আমরা একটা রেজাল্ট পাবো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ভেঙে ৮৫ বছর বয়সেও আওয়ামী লীগ নেতা অনুপম সেনের ভিসি পদে থাকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে নিজেদের এই সম্পদকে ফিরে পাওয়া। এটা ফিরে আসার পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তখন সবকিছুর সংস্কার করা হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ মঞ্জুর আলম বলেন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চসিকের সম্পত্তি। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটাকে নিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন সময় এসেছে। আমি চাইবো সিটি করপোরেশনের বর্তমান দায়িত্বশীলরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধিকার ফিরে পাক। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের পরিবার আত্মগোপনে গেছেন। নওফেল বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য হিসেবে থাকা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. অনুপম সেন মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে আসছেন। এরমধ্যে অনুপমের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের ছোট একটি পক্ষ আন্দোলন করছেন। আরেকটা পক্ষ ভিসি হিসেবে অনুপম সেনকে বহাল রাখতে মাঠে নেমেছেন।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১১/০৯/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.