ঢাকা: চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহ-শিক্ষামূলক বিতর্ক সংগঠন সোসিওলজিক্যাল ডিবেটিং সোসাইটি (এসডিএস)-এর সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসাইনকে অব্যাহতি দিয়ে শাস্তি প্রদান করেছেন সংগঠনটির মডারেটর অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন।
শনিবার (৬ জুলাই) সংঘটিত এই ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠনটিতে থাকা ২০২১-২২ সেশনের ২২জন বিতার্কিক একযোগে পদত্যাগ করেছেন।
এ বিষয়ে সোসিওলজিক্যাল ডিবেটিং সোসাইটি (এসডিএস)-এর অব্যাহতি পাওয়া সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসাইন বলেন, আমি কোটা সংষ্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এবং ফেইসবুকে কোটা আন্দোলন নিয়ে পোস্ট করায় আমাকে সংগঠন থেকে অব্যহতি/বহিষ্কার করা হয়েছে৷ সংগঠনের মডারেটর ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন স্যার একতরফাভাবে কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ তাছাড়া, আদালত অবমাননার দায়ে মামলা দেওয়ার হুকমি পর্যন্ত করেছেন।
তিনি বলেন, আমি এসব হুমকি এবং বহিষ্কারাদেশের কারণে একটুও বিচলিত বা ভীত নই৷ আমি এবং আমরা সহযোদ্ধারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোটা সংষ্কার আন্দোলন চালিয়ে যাব।
সংগঠনটির উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ বলেন, যে বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দিতে পারে না, যেখানে ছাত্রদের যৌক্তিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য একজন দায়িত্বশীলকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়, সেই বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১৬ তম ব্যাচ তথা ২০২১-২২ সেশনের বিতার্কিকরা একযোগে পদত্যাগ করেছে।
পদত্যাগকারী বিতার্কিকরা হলেন:
আতিক শাহরিয়ার (উপ-দপ্তর সম্পাদক), তানভীর আহমেদ রিফাত (উপ-অর্থ সম্পাদক), আবদুল্লাহ আল ফাহাদ (উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক), ইফফাত মেহেরাজ (উপ-তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক), উমা রানী (উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক), সুমাইয়া আক্তার (উপ-যোগাযোগ সম্পাদক), ফাতিমা তুন নাহার ঐশী (উপ-প্রশিক্ষণ সম্পাদক), সবুজ ইসলাম (উপ-পাঠাগার সম্পাদক), রিমন আকন্দ (উপ-অনুষ্ঠান ও আপ্যায়ন সম্পাদক), শাহরিন জান্নাত নীরা (উপ-সাহিত্য সম্পাদক), রাফিয়া সানজিদা (উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক), সাবিকুন্নাহার ইরিন (যুগ্ম আহবায়ক)।
ইংরেজি বিতর্ক বিষয়ক উপকমিটি :
নুসরাত জাহান নূহা (কার্যকরী সদস্য), নোশিন তাসনিম বাঁধন (যুগ্ম আহবায়ক), তাহসিন মাহতাব (সদস্য), মুনশি মুনাজ্জাহ জান্নাত (সদস্য), মাসউদূল বারী (সদস্য), জান্নাতুল আদনিন জিনিয়া (সদস্য), আবদুল্লাহ হিল কাফী (সদস্য), সামী সাঈদ দীপ (সদস্য), মিনহাজুল হাসান শাওন (সদস্য), সিরাজুম মুনিরা (সদস্য)।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ত্রাসের সংস্কৃতি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমেও আবাদ হয় তখন পুরো দেশের অবস্থা কল্পনা করতেও ভয় হয়। শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীদের মননশীল করে, চক্ষুসমান করে, সত্যকে সত্য, অন্যায়কে অন্যায় বলবার মত সাহসী করে গড়ে তোলা। কিন্তু শিক্ষক যখন দুর্বৃত্তায়নের চর্চা করে, পাড়ার মাস্তানের মত করে হুমকি দেয়, পোস্ট শেয়ার না করলে রেজাল্টে দেখে নেওয়া হবে, বিতর্কিত কার্যকলাপে (কোটা আন্দোলন) অংশ নেয়ার জন্য বিভাগের বিতর্ক ক্লাবের সম্পাদকে বহিষ্কার করে এবং অন্যরা অংশ নিলে বিপদ হবে বলে হুশিয়ারি করে, তখন শিক্ষককে শিক্ষক বলতে আমার লজ্জা করে, তখন শিক্ষককে আমার মনে হয় রাজনৈতিক ক্যাডার।
এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে খোলা গ্রুপগুলোতেও আদালত অবমাননা করে কোটা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে হুশিয়ারি প্রদান করেছেন। এ সংক্রান্ত কিছু স্ক্রিনশট কালবেলার হাতে এসেছে।
‘৪০০ পলিটিকাল সোশিওলজি’ নামক মেসেঞ্জার গ্রুপে বার্তা প্রদানের এক স্ক্রিনশটে দেখা যায়- অধ্যাপক জামাল লিখেছেন, বিতর্কিত কর্মকান্ডে যুক্ত থাকার জন্য ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদকের পদ হতে মোশররফকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। নতুন সাধারণ সম্পাদক সারাফ আফ্রা মৌ।
তিনি লেখেন, যারাই সমাজবিজ্ঞান বিভাগে বিতর্কিত-বিভাজিত কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হবেন, তারা কখনই ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বজনীন কমিটিসমূহের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। ক্লাস ক্যাপ্টেনসহ এ জাতীয় কোনো ধরনের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। যারা বাইরের ঘটনাকে নিয়ে বিভাগের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্টের কারণ হবে, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতীতেও এগুলো মোকাবেলা করা হয়েছে, এবারও মোকাবেলা করা হবে। আশা করি সংশ্লিষ্ট সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।
আরেক মেসেজে তিনি লেখেন, আদালত অবমাননা কর্মকান্ড করতে গিয়ে কেউ যদি মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার-জেল-শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখন কোনো শিক্ষক বা বিভাগের তরফ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা আসবে না।
সর্বশেষে তিনি সংবিধানের কিছু নীতি তুলে ধরে এক মেসেজে লেখেন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড ২১।
১. যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
২. যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১(এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
৩. যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, বা ৩(তিন) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এ প্রসঙ্গে অভিযোগ করে বিভাগটির ১৩তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী কালবেলাকে বলেন, জামাল স্যারের কোর্স শেষ হওয়া সত্তেও উনি উনার কোর্সের জন্য তৈরীকৃত মেসেঞ্জার গ্রুপে বিভিন্ন ধরনের বার্তা প্রদান করেন এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ফেইসবুক পোস্ট শেয়ার করতে বলেন। বর্তমান চলমান কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যেন অংশগ্রহন না করে সেজন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের বার্তা দিচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে ভীতি ছড়াচ্ছেন।
১৪তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, ৭ম সেমিস্টারে জামাল স্যারের ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকেই ওনার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ না নিলে নম্বর দিবেন না বলে হুমকিধামকি দিতেন। ইতোপূর্বেও চতুর্থ সেমিস্টারে উনি সোশ্যাল স্ট্যাটিসটিকস কোর্সে উনার পছন্দের স্টুডেন্টদের ভালো মার্কস দিতেন। সম্প্রতি কোটা আন্দোলনে অংশ যারা অংশ নিবে তাদেরও বিপদ হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীনকে মুঠোফোনে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সিনেট অধিবেশন চলাকালে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার যৌক্তিকতা বোঝাতে পবিত্র কোরআনের সুরা আনফালের একটি আয়াতকে ‘প্রমাণ’ হিসেবে দেখিয়ে বক্তব্য দেন ঢাবির এই অধ্যাপক। এসময় তিনি ২০১৮ সালে সংগঠিত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়দের ‘স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির’র কর্মী বলেও আখ্যা দেন তিনি।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৬/০৭/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.