এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে সব শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় তিন লাখের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে বিকল্প ব্যবস্থায় ট্রেডভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের আওতায় আনার সুপারিশ জানিয়েছে গণসাক্ষরতা অভিযান। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্যের হার কমিয়ে আনতে সরকারের কাছে ১৫ দফা সুপারিশ জানিয়েছে সংস্থাটি ।

মঙ্গলবার (১১ জুন) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলতায়নে গণসাক্ষরতা অভিযানের আয়োজনে ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলন ২০২৪’ অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের পাশাপাশি আমন্ত্রিত শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে এসব সুপারিশ জানানো হয়।
বক্তাদের মাধ্যমে উঠে আসা সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে―

১. পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
২. ফলাফল প্রকাশের পরপরই অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক অনুপ্রেরণামূলক কাউন্সেলিং সভা আয়োজন করা।
৩. অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা/প্রশিক্ষণের সাথে যুক্ত হওয়ার পরিবেশ সুযোগ সৃষ্টি করা।

৪. শিক্ষাব্যয় কমিয়ে এনে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা চালু ও শিক্ষায় সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করা।
৫. বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা। কোনো পদ খালি না রাখা। এ জন্য নিয়োগযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রস্তুত করা।
৬. এনটিআরসিএর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান/ত্বরান্বিত করা। সকল শিক্ষকদের চাকরি সরকারীকরণ করা।
৭. মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে।
৮. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা।
৯. শতভাগ শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি প্রদান করতে হবে। ন্যূনতম ৫০০ টাকা পর্যায়ক্রমে ১০০০ টাকা হওয়া উচিত।
১০. সকল বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি বেশি মনোযোগ ও গুরুত্ব দিতে হবে।
১১. সকল বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা।
১২. বিদ্যালয় মনিটরিং শক্তিশালী করতে হবে।
১৩. বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নতুনত্ব ও শক্তিশালী করতে হবে।
১৪. অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন ট্রেডভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। তাদের আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং কার্যক্রমের আওতায় আনা প্রয়োজন।
১৫. অকৃতকার্যরা যাতে ঝরে না পড়ে বিশেষ করে শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ রোধে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযানে নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ নজরুল ইসলাম খান, শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ব্যর্থ অধ্যায় আমাদের সবার নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। সাফল্য ও ব্যর্থতা আপেক্ষিক বিষয়, তবে সবাইকে সফলতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। জীবন একটা অন্তহীন লড়াই, যেখানে সফলতা ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। সেখানে সরকার চাইলেও সবাইকে চাকরি দিতে পারবে না। তাই শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয়ে ঘটাতে হবে। ফলে আমি বলব মেধাবীদের কারিগরি শিক্ষায় এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেই ফলাফল সবাই দেখতে পায়। এতে দুর্বল শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে একজনের ফলাফল অন্যজন জানেও না।’

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেই শেষ না। নিজেদের কোন বিষয় মেধা রয়েছে শিক্ষার্থীদের তা জানতে হবে। ভিন্ন ধারায় নিজেকে সফল করে গড়ে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক কারণেই আমাদের মেধা কম থাকতে পারে। আরেকটি অন্যতম কারণ আমাদের সম্পদের ঘাটতি। শিক্ষায় আমরা ভয়ংকরভাবে পিছিয়ে আছি। শিক্ষায় আমরা কোন জায়গায় আছি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোথায় যাবে জানা নেই। এর বড় কারণ আমরা ভূতলে বাস করি পাতালে বিনিয়োগ করি। ফলে ব্যয় সম্পর্কে আমাদের আরো সাবধান হতে হবে। শত প্রতিষ্ঠার পরও অকৃতকার্য শিক্ষার্থী থাকবেই। তবে সেই হার কমিয়ে আনার দায়িত্ব সরকারের।’

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘জার্মানিতে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টেকনিক্যালে পড়ে। আমাদের এই হার ছিল ৮.৫ শতাংশ। আমাদের শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশ গিয়ে শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে দক্ষতা না থাকার কারণে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের শুধু সার্টিফিকেট নয়, দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হবে। আমরা সেই প্রজম্ম গড়ে তুলতে চাই, যারা এই দেশকে তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান দিয়ে দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।’

শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘কভিডের সময় পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের হাতে যে স্মার্টফোন উঠেছিল তা এখনো নামেনি। আমি জানি না তারা এই ফোন দিয়ে কী করে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির তেমন ভালো না। কারণ পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া আমরা আর কিছু করতে পারি না। এবার তিন লাখ বাচ্চাকে বলা হয়েছে তারা অকৃতকার্য হয়েছে। পৃথীবির অনেক দেশে এই পরিমাণ জনসংখ্যা নেই। অকৃতকার্যদের মধ্যে অনেকে আছে যাদের নিজেদের কিছু ব্যতিক্রম ক্ষমতা আছে। তারা তাদের এই জ্ঞান দিয়ে সাফল্যের চূড়ায় এগিয়ে যেতে হবে।’

ড. কাজী খলীকুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের নীতি অনেক, অসংগতিও অনেক। সব সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হলে কোনো উন্নতি হবে না। সব যদি তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সিদ্ধান্ত দেন তবে আপনাকে রেখেছেন কেন? আমার মনে হয়, এসব বিষয়ে কেন্দ্রীভূতকরণ সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় দুর্নীতির সুযোগ থেকেই যাবে।’

শিক্ষাবিদ নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার ৭০ শতাংশ হলে ফেল করার কোনো সুযোগ নাই। এনটিআরসিএ আগে থেকে তালিকা নিয়ে ২০ শতাংশ শিক্ষক বাড়তি রাখা প্রয়োজন। যেন কোনো স্কুলে শিক্ষক অবসরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া যায়। কোনো প্রতিষ্ঠানে ক্যাশিয়ার না থাকলে সেখানে তো টাকা ভাগাভাগির কাজ চলবেই। এ ছাড়া বাইরের দেশের তুলোনায় আমাদের বইয়ে কন্টেন্ট অনেক কম। বেসরকারি পর্যায়ে এই বই লেখার কাজকে উৎসাহিত করতে হবে।’

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘জীবনের একটা শেষ প্রান্তে এসে ক্লাসের ভালো বা খারাপ ছাত্রদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আমার সহপাঠীরা সবাই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। শ্রেণিকক্ষে অকৃতকার্য হওয়া মানে জীবনে বিফল হওয়া নয়। প্রতিটি জীবনই সফল হয়, তবে সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম থাকতে হবে এবং দুর্নীতি থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে আমাদের ডাক্তার, পাইলট বা ইঞ্জিনিয়ার এ ধরনের কর্মযজ্ঞের জন্য অবশ্যই ভালো শিক্ষার্থী প্রয়োজন।’

দুটি সেশনে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে নিজেদের সফলতার গল্প শুনিয়েছেন এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত, সংগীতশিল্পী নকিব খান, ফাহমিদা নবী ও রাহুল আনন্দ। অনুষ্ঠানের দুটি সেশনের শেষাংশে সংগীতশিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১২/০৬/৩০২৪ 


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading