Breaking News

তাপপ্রবাহে এশিয়া–আফ্রিকায় বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রেণিকক্ষের বাইরে ৪ কোটি শিক্ষার্থী

ঢাকাঃ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার দেশের বিগত এক দশকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়। দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোরে সেদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রাজধানীর তাপমাত্রাও ৪০–এর আশপাশেই থাকছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিন গরমজনিত মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। তীব্র গরমের কারণে শিক্ষার্থীরা বাড়িতেও পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে না।

একই পরিস্থিতি চলছে এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায়। এসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ হিসাবে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শ্রেণিকক্ষের বাইরে ছিল। অর্থাৎ তাপপ্রবাহের কারণে এক দিকে বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ, অন্যদিকে তীব্র গরমে বাড়িতেও সেভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর প্রবণতা না কমায় জলবায়ু ক্রমেই উষ্ণ হয়ে উঠছে। ফলস্বরূপ তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে সরকার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ক্রমবর্ধমানভাবে এমন একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যা শিক্ষা কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। তীব্র গরমের মধ্যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালু রাখা হবে, নাকি বাড়িতে শীতল পরিবেশে থাকতে উৎসাহিত করা হবে—এ নিয়ে একটা দোদুল্যমানতা দেখা যাচ্ছে।

এই দুইয়ের মধ্যে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন তার একটা নেতিবাচক ফলাফল রয়েছে। যেখানে জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে স্কুলে যাওয়ার বয়সী প্রায় ১৭ শতাংশ শিশু এরই মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের বাইরে রয়েছে। অর্থাৎ এই শিশুরা কখনোই স্কুলে যায় না। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই অনুপাতটি অনেক বেশি। যেমন সাব–সাহারা আফ্রিকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে, যেখানে উত্তর আমেরিকায় এ অনুপাত মাত্র ৩ শতাংশ।

এ ছাড়া উন্নয়নশীল বিশ্বের শিশুদের সাধারণ মান পরীক্ষার স্কোর উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি বৈশ্বিক বৈষম্যও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সেই সঙ্গে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যকার শিখন ব্যবধান বাড়িয়ে তুলতে পারে এই তাপমাত্রার বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনকি ধনী দেশগুলোতেও ধনী ও দরিদ্র এলাকার মধ্যে এই ব্যবধান বাড়তে পারে। কিন্তু এত গরমের মধ্যে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠালে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

দক্ষিণ সুদানে এ বছর মার্চের শেষের দিকে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গেলে প্রায় ২২ লাখ শিক্ষার্থীর বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফিলিপাইন এবং ভারতের হাজার হাজার স্কুল এপ্রিলের শেষের দিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ দুই দেশে ১ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর ক্লাস বন্ধ।

আজ বুধবার কম্বোডিয়ায় দুপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এড়াতে সব সরকারি স্কুলকে খোলা রাখার সময় দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর স্কুল খোলা নাকি বন্ধ রাখা হবে— এ নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন অভিভাবকেরা। যদিও অনেক জেলাতে তাপমাত্রা বিপজ্জনক স্তরে উঠে গেছে।

অলাভজনক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, বাংলাদেশের অনেক বিদ্যালয়ে বৈদ্যুতিক পাখা নেই, বায়ু চলাচলের (ভেন্টিলেশন) অবস্থা ভালো নয়। অনেক বিদ্যালয়ের ছাদ টিনের। ফলে গনগনে রোদের মধ্যে শ্রেণিকক্ষগুলো আরও গরম হয়ে ওঠে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেও যদি শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায় তাহলেও কিন্তু তাদের শিখনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ উচ্চ তাপমাত্রা মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপকে ধীর গতির করে দেয়। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণ ও প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা কমে যায়।

২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষার বছরে উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে থাকে তবে তারা পরীক্ষায় আরও খারাপ ফল করে।

আমেরিকান ইকোনমিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষাবর্ষ শূন্য দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হলে সেই বছরের শিখন ১ শতাংশ কমে যায়। গবেষণার সহ–লেখক বোস্টন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জশ গুডম্যান বলেন, তবে গবেষণার অধীন যেসব বিদ্যালয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছিল সেগুলোতে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মার্কিন বিদ্যালয়ে অন্তত আংশিক এয়ার কন্ডিশনার রয়েছে। এর বাইরের বিদ্যালয়গুলো সাধারণত দরিদ্র এলাকাগুলোতে অবস্থিত। এসব বিদ্যালয় এরই মধ্যে ধনী এলাকাগুলোর চেয়ে শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে।

গুডম্যান এবং তাঁর সহকর্মীরা তাপমাত্রার সঙ্গে শিখন পরিস্থিতির একই সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা অন্যান্য দেশের সাধারণ পরীক্ষার তথ্য তুলনা করে দেখেন। গুডম্যান বলেন, এই অঞ্চলগুলোতে শিক্ষার্থীরা যে বছর বেশি তাপমাত্রা অনুভব করে, দেখা গেছে, সে বছর তারা শিখেছে কম।

এ ছাড়া অন্যান্য গবেষণার পর্যবেক্ষণেও দেখা যায়, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত তাপমাত্রা এমনকি অনাগত শিশুর শিখনকেও প্রভাবিত করতে পারে।

২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার যেসব শিশু জরায়ুতে থাকা অবস্থায় এবং জীবনের প্রথম সময়ে (শৈশব–কৈশোর) গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রার সংস্পর্শে দীর্ঘ সময় থাকে, তারা পরবর্তী জীবনে কম সময় স্কুলে পড়াশোনা করে। প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস–এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

গুডম্যান বলছেন, এ সবই উদ্বেগজনক। কারণ বিশ্ব উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরই মধ্যে উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলো অত্যন্ত গরম জলবায়ুর দিকে যাচ্ছে। এসব দেশ নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গুডম্যান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন গরম এবং শীতপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষার ব্যবধান বাড়িয়ে দেবে। কিছু উন্নত দেশ এরই মধ্যে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।

গত মার্চে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) ঘোষণা করেছে, জর্ডানে ২০২৬ সালের মধ্যে ৩০টি তাপ–প্রতিরোধী স্কুল নির্মাণ করবে তারা। সংস্থাটি বলছে, জর্ডানে সামনে প্রচণ্ড গরমের দিন বাড়বে। সেই সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি এটি।

ইউএসএআইডি বলেছে, গরমের মধ্যেও বিদ্যালয়ের পাঠদান চালু রাখতে সাহায্য করার জন্য প্যাসিভ কুলিং সিস্টেম এবং এয়ার কন্ডিশনার ব্যবস্থা বসাতে ৮১ লাখ ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচণ্ড গরমের কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার সংখ্যা বেড়েছে। যদিও মাত্র কয়েকটি দেশই এই ধরনের ডেটা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে থাকে।

মার্কিন বিদ্যালয়গুলো এখন অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে প্রতি বছর গড়ে ছয় থেকে সাত দিন ক্লাস বাতিল করছে। যেখানে এক দশক আগে এটি ছিল প্রায় তিন থেকে চার দিন। ২০২১ সালে বিদ্যালয় এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা দিয়ে একটি গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া পল চিনভস্কি এ তথ্য দিয়েছেন।

সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশে গত বছর ৬–৭ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। তবে এ বছর, ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ বন্ধ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় মে মাস সাধারণ সবচেয়ে উষ্ণ থাকে।

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০১/০৫/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

একসঙ্গে ৫ নারী বিচারপতি নিয়োগ; ইতিহাস সৃষ্টি সুপ্রিম কোর্টে

ঢাকাঃ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রথমবারের মতো ৫ …