শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে শরীফার গল্পটি থাকছে। এটিতে ভাষাগত নূন্যতম পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ওই গল্পে ‘বিতর্কের’ কিছু পাচ্ছেন না। সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে পাঠের অংশ হিসেবে ‘শরীফার গল্প’ রাখা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ নামক একটি অধ্যায়ে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ নামের একটা গল্প যুক্ত করা হয়েছে। নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল।
এরপর গল্পটি পর্যালোচনার পাশাপাশি এ বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য গত ২৪ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় তিন মাসের মাথায় এ কমিটি তাদের প্রতিবেদন ‘চূড়ান্ত’ করতে যাচ্ছে; তাতে গল্পটি পাঠ্যক্রমে রাখার সুপারিশ থাকছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
পাঁচ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইআরবি) উপাচার্য আবদুর রশীদ গতকাল বলেন, ‘আমরা খুব শীঘ্রই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেব। আমরা পাঁচজন সম্মিলিতভাবে মতামত দেব। এনিয়ে কাজ চলছে।’
শরীফার গল্প রাখার সুপারিশ করা হচ্ছে-কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবার মতামত ছাড়া আমি কীভাবে বলি?’
এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। কমিটির তিন সদস্য হলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর কফিল উদ্দীন সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা সরকারি আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ।
কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ্য থেকে নতুন শিক্ষাক্রম সর্ম্পকে কিছু ‘প্রশ্ন’ উত্থাপন করা হয়েছিল। অথচ কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সরকার স্বীকৃত আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের কোনো মিল নেই।
ওইসব কর্মকর্তা জানান, কওমি মাদ্রাসায় যেসব বিষয় বা পাঠ্যক্রম রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে সরকারি প্রশাসনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সাধারণ শিক্ষায় যে পাঠ্যক্রম পড়ানো হচ্ছে সেগুলোও কওমি মাদ্রাসায় পড়ানো হয় না। এ কারণে সাধারণ শিক্ষাক্রম নিয়ে কওমি আলেম ও হেফাজতে ইসলামের আপত্তিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ শিক্ষা প্রশাসন। ‘শরীফ থেকে শরীফার’ গল্প নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করা হচ্ছে বলে শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেছেন, সরকার ‘ট্রান্সজেন্ডারকে’ স্বীকৃতি (২০১৩ সালে) দিয়েছে, কারণ তারা সমাজেরই অংশ।
বইটি তিনবার ‘রিভিউ’ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বই রিভিউয়ের সময় ‘ইনক্লুশন স্পেশালিস্ট, জেন্ডার স্পেশালিস্ট’ ছিলেন। তারা সবকিছু দেখে বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন। বইতে যা দেয়া হয়েছে, তা ‘সময়ের প্রয়োজন’ বলে জানান এনসিটিবি চেয়ারম্যান।
চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরানা পল্টনে ফেনী সমিতি মিলনায়তনে সংগঠনের আমির শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন-২০২৩ (খসড়া)’ বাস্তবায়ন না করার দাবি জানান।
তারা বলেন, এ আইনটিকে যদিও হিজড়া সম্প্রদায়ে অধিকার সুরক্ষা আইন মনে করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসলে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার এক নয়।
হেফাজত নেতাদের দাবি, পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ হওয়ার গল্প আছে। এই ধরনের ট্রান্সজেন্ডারের গল্প পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘মগজধোলাই’ করা হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘শরীফ থেকে শরীফা’র গল্পের বিষয়টি আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অথচ এ গল্প নিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকরা আপত্তির কিছু পাচ্ছেন না।
মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের
চলতি শিক্ষাবর্ষে ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। এবার ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। ইতোমধ্যে শিক্ষাবর্ষের প্রায় চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটেনি।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে গত ৫ মার্চ একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৪ সদস্যের এই কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সুপারিশ বা মতামত দেবে। এ কমিটি পাবলিক পরীক্ষাসহ মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে তা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে সুপারিশ করবে।
এছাড়া পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সংশোধন, পরিমার্জন এবং নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় পর্যালোচনা ও সুপারিশ দিতে পারবে এ কমিটি। এ কমিটির সর্বশেষ সভা গত ২১ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘সভায় চূড়ান্ত কিছুই হয়নি। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সর্ম্পকে একটি পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়েছিল। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত এসেছে। এগুলো নিয়ে এখন কাজ চলছে।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (উন্নয়ন) আহ্বায়ক ও একই বিভাগের যুগ্ম-সচিবকে (সরকারি মাধ্যমিক অধিশাখা) ওই মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে ১২টি বোর্ড, অধিদপ্তর ও উন্মমুক্ত বিশ^বিদ্যালয় থেকে একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের ৮ম ও ৯ম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাবর্ষ থেকে ৯ম শ্রেণীতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজনও থাকছে না।
২০২৫ সালে এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণীতে উঠবে, ওই সময়ও বিভাগ বিভাজনের সুযোগ থাকবে না। ২০২৬ সালে এ শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
কী আছে শরীফার গল্পে
সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ ১৬ পৃষ্ঠার এই অধ্যায়ে শরীফার গল্প আছে দুই পাতাজুড়ে। ৩৭৪ শব্দের এই গল্পে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য, এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরদের সচেতন করা।
শরীফার গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম দুটো- শরীফ এবং শরীফা। শরীফ আহমেদ এক সময়ে শরীফা আকতার হয়ে যান, যিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
গল্পটা এরকম, শরীফাদের শ্রেণী শিক্ষকের ডাক নাম খুশি, তাকে শিক্ষার্থীরা খুশি আপা হিসেবে সম্বোধন করে। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের খেলার ছলে ‘সম্প্রদায়’ সম্বন্ধে শেখাচ্ছেন।
খুশি সেদিন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য লিখে শ্রেণী কক্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি নিজ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদের দাঁড়াতে বলেন। শিক্ষার্থীরা সহজভাবে একটা কঠিন বিষয় সমন্ধে জানতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত।
শিক্ষার্থীরা যাতে কাছ থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখতে পারে, তাই তিনি পরদিন ক্লাসে একজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। যার নামই শরীফ ওরফে শরীফা। এখান থেকেই গল্পের শুরু। শরীফা এ স্কুলেরই এক সাবেক শিক্ষার্থী।
তাকে খুশি আপা পরিচয় করিয়ে দেন, ‘ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন, নিজের স্কুলটা দেখতে।’ এরপর শরীফা শিক্ষার্থীদের নিজের পরিচয় জানিয়ে বলেন, ‘যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ।’
তখন আনুচিং নামের এক শিক্ষার্থী অবাক হয়ে জানতে চায়, শরীফা কীভাবে মেয়ে হলো? তখন শরীফার উত্তর ছিল, ‘আমি তখনও যা ছিলাম, এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি।’
তখন শরীফা বলেন, ‘ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।’
শরীফা বলেন, ‘মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়া-পড়শি এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম একথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।’
বারবার অবহেলিত হওয়ার কথা তুলে ধরে শরীফা বলেন, ‘একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে, কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)।’
গল্পে শরীফার ভাষ্য, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা করতে। কিন্তু ২০১৩ সালে সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু মানুষ এখনও তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না।
এই গল্পে সমকামিতা বা ট্রান্সজেন্ডার সর্ম্পকে কোনো কিছু বলা নেই। সপ্তম শ্রেণীর বইয়ের এ অধ্যায়ে বেদে সম্প্রদায় ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিয়েও আলাদা পাঠ আছে। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের মানুষের গল্প এই বইতে উঠে এসেছে। সূত্রঃ সংবাদ
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৩/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.