ডা. এম শমশের আলীঃ রক্তচাপ হলো- রক্ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণ করার জন্য প্রেসার বা চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রক্ত হার্ট থেকে রক্তনালির মাধ্যমে সারা শরীরে পৌঁছে যায়। এ প্রক্রিয়ায় রক্ত প্রবাহের চাপ হার্ট তার মাংসপেশি সংকোচনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে রক্ত প্রবাহ পরিচালনা করে থাকে। তবে রক্ত হার্ট থেকে যত দূরে যেতে থাকে রক্তচাপও আনুপাতিক হারে কমতে থাকে।
রক্তনালির ভিতর দিয়ে রক্ত প্রবাহের সময় রক্তনালির দেয়ালে বা ওয়ালে প্রবাহ বরাবর চাপ ও পার্শ্বচাপ এ দুই ধরনের চাপ পরিলক্ষিত হয়। চিকিৎসকরা হাতে এক ধরনের বায়ু ধারণে সক্ষম বন্ধনী পেঁচিয়ে তার মধ্যে বাতাস ঢুকিয়ে চাপের সৃষ্টি করে। হাতের ভিতর থাকা রক্তনালি চুপসে দিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে তারপর চাপ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট চাপের আর চুপসানো রক্তনালিটি খুলে যায় এবং আবার রক্ত প্রবাহ শুরু হয়ে যায়। এ পরিমাণ চাপকে সিস্টলিক রক্তচাপ বলে পরিমাপ করা হয়।
বন্ধনীতে চাপ আরও কমাতে থাকলে এক পর্যায়ে রক্তনালি সম্পূর্ণভাবে খুলে যায়। এ পরিমাণ চাপকে ডায়াস্টলিক প্রেসার বলা হয়। হাই প্রেসার কেন হয় তা পুরাপুরিভাবে এখনো জানা সম্ভব হয়নি। রক্তচাপ নীরবে নিভৃত্বে বৃদ্ধি পেতে থাকে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে, উচ্চ রক্তচাপের বা হাই প্রেসারের জন্য কোনোরূপ লক্ষণ বা সিমটম পরিলক্ষিত হয় না। তবে অনেকে মনে করেন ঘাড় ও মাথা ব্যথা প্রেসারের লক্ষণ। এর একটা যুক্তি আছে যে, কোনো ব্যক্তি টেনশন বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হলে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় যাকে এক কথায় ট্রেস হরমোন বলা হয়।
এ হরমোনের প্রবাহে রক্তচাপ সাময়িক বৃদ্ধি পেতে পারে এবং টেনশনের জন্য মাথা, ঘাড় ব্যথা হতে পারে। টেনশন স্থায়ী হাই প্রেসারের একটি কারণও বটে, বিশেষ করে যারা দীর্ঘসময় ধরে টেনশনে ভুগছেন। যেহেতু রক্তচাপ প্রায় সময়ই কোনোরূপ উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ করে না। তাই একে নীরব ঘাতক রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রক্তচাপ দীর্ঘদিন ধরে বেশি থাকলে ধীরে ধীরে কিডনি অকেজো হয়ে যায়, হার্ট অধিক প্রেসারের বিপরীতে রক্ত পাম্প করতে করতে মোটাতাজা হয়ে যায়, মানে তার মাংসপেশির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে অক্সিজেন ও রসদের প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়, ফলশ্রুতিতে হার্টের মাংশপেশি চাহিদার তুলনায় কম রক্ত সরবরাহ পায়।
তার সঙ্গে সরবরাহ লাইনে কোনো প্রতিবন্ধকতা বা ব্লক থাকলে অতি সহজেই অক্সিজেনের স্বল্পতাজনিত লক্ষণ যেমন বুক ব্যথা, বুকে চাপ অনুভব করা, উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবে হার্ট ফেইলুর ও হার্ট অ্যাটাকের মতো জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। উচ্চরক্তচাপের ফলে চোখের রক্তনালিতে এক ধরনের পরিবর্তন এথেরোসক্লেরোসিস পরিলক্ষিত হয়। দিনে দিনে এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি শক্তি কমতে থাকে কখনো কখনো চোখে রক্তক্ষরণ হয়ে দ্রুত অন্ধত্ব সৃষ্টি হতে পারে।
ব্রেইনের রক্তনালিতেও এথেরোসক্লেরোসিস (প্লাগ) সৃষ্টি হয়ে মস্তিকের রক্ত প্রবাহ কমিয়ে এর কার্যকারিতা স্থবির করে দিতে পারে, ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি ভুলে যাওয়া, কানে কম শোনা, শারীরিক দুর্বলতা, দৃষ্টিহীন হওয়া, ধৈর্যশ্রুতি দেখা দেওয়া, সহজেই রাগান্বিত হয়ে পড়ার মতো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। হঠাৎ রক্তনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এ অবস্থাকে ব্রেইন স্ট্রোক বলা হয়। ব্রেইন স্ট্রোকের আর একটি কারণ হলো উচ্চরক্তচাপ বা হাইপ্রেসারের প্রভাবে কোনো একটা রক্তনালি ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার ফলেও স্ট্রোক সৃষ্টি হয়ে থাকে।
তবে আশার কথা হলো, রক্তচাপ সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে উপরে উল্লিখিত জটিলতা বহুলাংশে লাঘব হবে এবং ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবন ও কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে পারবে। অনেক সময় হাইপ্রেসারের পরিমাণ বেশি থাকলে তা যেমন ক্ষতিকর, ব্রেইন স্ট্রোকের জন্য রক্তচাপের ওঠানামা /আপ-ডাউন বেশি হলে তা আরও অধিক ক্ষতিকর। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ যদি অত্যধিক পরিশ্রমে নিয়োজিত হন, আপদ-বিপদে পড়ে যান অথবা হঠাৎ রাগান্বিত হয়ে গেলে, উত্তেজিত হয়ে গেলে রক্তচাপ খুব দ্রুত বেড়ে যায় এতে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যারা প্রেসারের মেডিসিন অনিয়মিত গ্রহণ করেন, তাদের রক্তচাপ খুব বেশি ওঠা-নামা করে। তাতে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়ে স্ট্রোকের সৃষ্টি করে থাকে। তাই রক্তচাপের মেডিসিন অনিয়মিত খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াই ভালো। তাই এ বিষয়ে আমাদের আরও যত্নবান হতে হবে।
লেখক : চিফ কনসালটেন্ট, শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৪/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.