ফিরোজ আলম:
আসছে উৎসব তো চলেই যাচ্ছে,
গ্লানির- কলঙ্ক রটনা করে।
ঠিক পরের উৎসবে পত্র পাব কিনা,
বিবরণে ঠিক জানিয়ো।
এ কবিতার মত উৎসব ভাতার প্রত্যাশা সরকারের কাছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের
বর্তমানে উৎসব ভাতা বা বোনাস ব্যবস্থায় চরম অস্থিরতা,বৈষম্য,চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। কারো বোনাস চার আনা, কারো আটআনা আবার কারো ১৬ আনা। অথচ উৎসবের রং সবার সমান। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির মতে, ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা সরকারি- বেসরকারি সবার সমান। মানে হল বৈশাখীর রং হিন্দু- মুসলিম সবার জন্য।তাই ভারত সরকারের প্রভাবে হয়ত বৈশাখী ভাতা সমান।কিন্তু ঈদ উৎসব শুধু মুসলিমদের।তাই ভাতা নির্ধারনে সরকার একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা।তাইতো মুসলিমদের উৎসব বলে সরকারি নিয়মে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ ঈদ উৎসব ভাতা গত ২২ বছরে ও পরিবর্তন হয়নি।আমি এসবে বিশ্বাস করিনা।কিন্তু মাঝে মাঝে নিজের পক্ষে কোন যুক্তি ও দিতে পারি না।ছয় লক্ষ শিক্ষককে যদি সরকারের মুখোমুখি করানো হয় তাহলে প্রায় শতভাগ শিক্ষক ই সরকারের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়নকারীদের সাথে কথা না বাড়িয়ে ছোট বেলার মত অন্যায়ের শাস্তি হিসেবে তাদের তুলোধোনা করে দিবে নিশ্চিত।দেশের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯৭ শতাংশ এমপিওভুক্ত।যেখানে প্রায় ছয় লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মূল বেতনের পুরো অংশ, সরকারি বিধি অনুযায়ী মূল বেতনের ২০ শতাংশ, বৈশাখী ভাতা এবং বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, বাড়িভাড়া বাবদ মাসে এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা বাবদ ৫০০ টাকা সরকার দিলেও দুই ঈদে শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা দেয়া হয়। এদিকে শিক্ষকদের শতভাগ ঈদ বোনাস বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চায় প্রস্তাব, মাউশি চায় নির্দেশনা- এমন লুকোচুরি ও প্রতারনার ফাঁদে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঈদ উৎসব বেদনার রংয়ে ছেঁয়ে গেছে।এদিকে দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির বর্তমান বাজারে এমপিভুক্ত শিক্ষকরা আসন্ন ঈদ উল ফিতরে দিশেহারা।চতুর্থ গন বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক হওয়া প্রায় সকল শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়াকে নিজেদের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিতাপ করছেন । একজন সহকারী শিক্ষক বেতন হিসেবে সব মিলিয়ে ১২ হাজার ৭৫০ টাকা, সাথে ঈদ বোনাস হিসেবে তিন হাজার ১৫০ টাকা যেটুকু পান তা যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বল্প যোগ্যতার অফিস সহকারীর বেতনের চেয়েও কম।
এ কথা সবার জানা, শিক্ষকদের আন্দোলন ও দাবির মুখে ২০০৩-০৪ সালে তৎকালীন সরকার তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষকদের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা যখন দিয়েছিলেন, তখন আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, পরবর্তী অর্থবছরে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রেখে শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা দেয়া হবে। এখন তো শিক্ষকদের আন্দোলন ই নিষিদ্ধ।যারা শিক্ষক অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামবেন, তাদের পরিনীতি করুন হবে সেটা ও প্রমানিত।ফলে শেষ ২২ বছরে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।তাই নিন্দুকেরা বলে, তৎকালীন সরকার ও ক্ষমতায় আসতে পারে নি, আর উৎসব ভাতা ও শতভাগ হয়নি।এ কথা সত্য যে, বৈশ্বিক মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং বৈদেশিক মুদ্রা, রাজস্ব আদায় ও আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা, জনতুষ্টি আর অর্থনীতি রক্ষার মধ্যে সমন্বয় করার মতো চ্যালেঞ্জ সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল।
কিন্তু এ কথাও মিথ্যা নয় যে, শিক্ষকদের ভাতে ও সম্মানে মারার সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ।রংহীন উৎসব আর শিক্ষকদের ক্ষুধার্ত পেটে আবার নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সরকারের কঠোর হুশিয়ারিতে বিপাকে শিক্ষক।
সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি বিদ্বেষ থেকে নয় বরং সবার জ্ঞাতার্থে বলছি, সরকারি চাকরিজীবীদের প্রধানত দুটি উৎসব ভাতা থাকে। তা মূল বেতনের সমপরিমাণ। তাদের জন্য আরো রয়েছে ৪৫ শতাংশ মাসিক বাড়িভাড়া, নববর্ষের ২০ শতাংশ উৎসব ভাতা, প্রতি মাসের বেতনের সাথে এক সন্তান থাকলে কমপক্ষে ৫০০ টাকা, দুই সন্তান হলে ১০০০ টাকা, শিক্ষা সহায়তা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা মাসিক সর্বনিম্ন ১৫০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা, মৃত্যুবরণ করলে পরিবার পাবে সাড়ে আট লাখ টাকা ভাতা। এর পাশাপাশি সরকার প্রদত্ত ৪০০ টাকা স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা বীমা। ১০ নাম্বার থেকে ১৬ নাম্বার গ্রেডে চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে যাতায়াত ভাতা মাসে ৩৬০ টাকা। ৩নং গ্রেডের উপরের কর্মকর্তাদের গাড়ি সুবিধার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার বিষয়টি বিবেচনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। মাসে টিফিন ভাতা ৩০০ টাকা। এছাড়া রয়েছে শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা। সব শ্রেণীর সরকারি চাকরিজীবীকে বর্তমান প্রচলিত প্রতি তিন বছরের স্থলে ২ বছর অন্তর ১৫ দিনের গড় বেতনে অর্জিত ছুটিসহ এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিজীবীদের ধোলাই ভাতা মাসে ১৫০ টাকার সুপারিশ করা হয়েছে। কার্যভার ভাতা সর্বোচ্চ সীমা মাসে দুই হাজার ৫০ টাকা উন্নীত করা হয়েছে। রয়েছে গৃহকর্মী ভাতা, পোশাক পরিচ্ছদ সুবিধা, ২০ শতাংশ হারে পাহাড়ি ও দুর্গম ভাতা। হাওর-বাঁওড়, দুর্গম দ্বীপ অঞ্চলে উপকূলীয় ভাতা।
উচ্চ পদস্থদের রয়েছে আপ্যায়ন ভাতা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব তিন হাজার টাকা, সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তা দুই হাজার ৫০০ টাকা, অতিরিক্ত সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তা দুই হাজার টাকা, যুগ্ম সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এক হাজার ৫০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। রয়েছে ভ্রমণ ভাতা। বদলিজনিত ভ্রমণ ভাতা, এককালীন সড়ক পথে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা, ১০১ থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১৫ হাজার ৫০০ টাকা, ২০১ থেকে এর বেশি কিলোমিটার হলে ২০ হাজার টাকা ভ্রমণ ভাতা। আরো রয়েছে পেনশনযোগ্য চাকরিকাল। প্রথম গ্রেড থেকে ১৬ গ্রেড পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পেনশনযোগ্য চাকরিকাল পাঁচ বছর থেকে শুরু করে ২৫ বছর। এ সময় পেনশনের হার গ্রেড অনুযায়ী ২০ শতাংশ থেকে গ্রেড অনুযায়ী ৯০ শতাংশ। রয়েছে আবাসন ও গৃহনির্মাণ ঋণ প্রকল্প। সরকারি চাকরিজীবীদের ঋণের পরিমাণ গ্রেড অনুযায়ী ১২ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা গৃহঋণ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সুদের হার হবে ব্যাংক রেটে পাঁচ শতাংশ। এর পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে খাসজমি চিহ্নিত করে সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসনে প্রকল্প গ্রহণ করা। অষ্টম থেকে প্রথম গ্রেড স্কেলের কর্মকর্তাদের ২০ জনের জন্য ১০ কাঠা ও অন্যান্য চাকরিজীবী প্রতি ২০ জনের জন্য ৮ কাঠা প্লট দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আরো অনেক সুবিধা রয়েছে। উপরিউক্ত সুযোগ সুবিধা তারা পান আমরা মনেপ্রাণে তা চাইও বটে। একজন মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে জীবন ধারণে উপরিউক্ত সুবিধাগুলো অপরিহার্য।
কিন্তু সমস্যা হলো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। সরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস মূল বেতনের ১৬ আনা হলে বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় চার আনা ও কর্মচারীদের বেলায় আট আনা পরিমাণ।
যারা সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য উৎসবের সংজ্ঞা আলাদা করে দিয়েছেন।তারা এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষকের ছেলে-মেয়েরা ঈদ করবে কাদের সাথে,কোন পৃথক সমাজে সে ব্যবস্থা করেন নি কেন?যেখানে সরকারি অফিসের একজন পিয়ন, বেসরকারি শিক্ষকের চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি বোনাস পান, সে ক্ষেত্রে জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকসমাজের ভাতে না মেরে সন্মানে মারার চিন্তা কোথা থেকে আসে?
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের তথ্যসূত্রে জানা যায়,সারাদেশে স্কুল- 16863 টি,কলেজ -2658 টি,মাদরাসা-8229 টি,কারিগরি -2137।মোট-29837 টি
শিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা-স্কুল-272283 জন,কলেজ-94202জন,মাদরাসা-167506 জন,কারিগরি-20588 জন,মোট-শিক্ষক=553009 জন।সরকার উৎসব ভাতা দেয় প্রায় 750 কোটি।এটাকে শতভাগ করতে বাড়তি প্রয়োজন ২২৫০ কোটি টাকা।বাজেট থেকে বলছি,একজন প্রধান মন্ত্রীর প্রতি দিনের অফিস খরচ ১০ কোটি যা বছরে ৩৬০০ কোটি টাকা।তাহলে শতভাগ উৎসব ভাতা কার্যকর করা তো মামুলি বিষয়।এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদান করলে কি দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে? যদি কেউ এটিকে নিছক অপচয় এবং অসম্ভব মনে করেন তাদের জন্য বলি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেল কেলেঙ্কারি, বিমানের বার্ষিক বিশ হাজার কোটি টাকা লোকসান,পদ্মা সেতুর বিলম্ব লোকসান, ইত্যাদি সব কেলেঙ্কারিতে কি দেশের হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়নি? তবু সরকারের সব কাজ চলমান রয়েছে। শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সরকার, মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাদরাসা ও কারিগরি অধিদপ্তরের যত অজুহাতের ছড়াছড়ি।
তাই বলব,উৎসবের রং ধর্ম- বর্ন ছাড়িয়ে যাক,নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নকারী শিক্ষকদের উৎসব অসহায়ত্বের হাতছানির অবসান হোক,বিবেকের অপমান দূর হোক,
স্মার্ট দেশ গঠনে উৎসব ভাতা শতভাগ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সম্মানের পথ উন্মুক্ত হোক।
লেখক-
ফিরোজ আলম
বিভাগীয় প্রধান,অনার্স. এম.এ শাখা
আয়েশা রা: মহিলা কামিল মাদরাসা,সদর,লক্ষীপুর।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.